|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
সিরিয়ায় এখন ‘ওরা’ বনাম ‘ওরা’ |
এক দিকে বিদ্রোহীদের পক্ষে অস্ত্র ধরেছে আল কায়দা, অন্য দিকে প্রেসিডেন্ট আসাদের পাশে
দাঁড়িয়েছে
হিজবুল্লা! দু’পক্ষই জঙ্গি, দু’পক্ষই জিহাদি। সিরিয়ায় আজ যে ভ্রাতৃঘাত, কোন কারবালায় তার শেষ হবে?
সেমন্তী ঘোষ |
কোনও একটা ছবি দিয়ে তার পিছনের ঘটনাকে বুঝতে যাওয়ার মধ্যে একটা ভয় থাকে। সরলীকরণের ভয়। সত্যিই তো, একটামাত্র ছবির মধ্যে বাস্তবের নানা স্তর ফুটে উঠতে পারে না। মাঝেমধ্যে তবু আশ্চর্য ব্যতিক্রম ঘটে যায়, এই যেমন সম্প্রতি ঘটল। গত পরশু একটি ছবিতে দেখা গেল, সিরিয়ায় দু-দুটো বছর ধরে যে বিদ্রোহ চলছে, সেখানে নাকি যুযুধান বিদ্রোহীদের এক সদস্য বিপক্ষের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সৈন্যের মৃতদেহ খুবলে বার করে নিয়েছে তার হৃৎপিণ্ড, এবং তাতে কামড় বসিয়েছে। ইন্টারনেটে দিকে দিকে ছবি, বন্দুকধারী বিদ্রোহীর হাতে কাঁচা হৃৎপিণ্ড, ঠোঁটে-মুখে রক্তের ধারা! বিদ্রোহীরা নাকি আগেই শপথ আউড়েছিল ‘প্রেসিডেন্ট আল-আসাদের কুকুর-বাহিনী, ধরতে পারলে তোদের হৃৎপিণ্ড ভক্ষণ করে ছাড়ব।’— এই পুরো বিবরণ পড়ামাত্র কী মনে পড়ে? কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সেই বুক চিরে রক্তপানের ছবিটাই ভেসে ওঠে না? সে-ও তো ছিল প্রতিজ্ঞা-রক্ষার্থেই? কী ভীষণ প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি, কী বিপুল শোক ও ক্ষোভ, কী আক্ষরিক ‘অমানুষিক’ জিঘাংসা: অতীত-বর্তমান, সাহিত্য-রাজনীতি, কল্পনা-বাস্তব, সব যেন গুলিয়ে যায় এর সামনে। আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করতে হয় যে, এই সেই ব্যতিক্রমী ছবি যেখানে ছবিটার মধ্যে সত্যিই ফুটে উঠেছে পিছনের কাহিনির বিপুলবিস্তারী জটিল বাস্তব। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেরই পটভূমি সিরিয়ায়, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের উত্তাল রক্তপ্লাবন।
‘ভ্রাতৃঘাতী’ কথাটা নেহাত লেখার টানে লেখা নয়! সব মানুষই ভাই, কিংবা সব মুসলমানই ভ্রাতৃত্বসম্পর্কে আবদ্ধ, এই সব ‘ক্লিশে’ ছাড়িয়ে কথাটার মানে কিন্তু আরও প্রত্যক্ষ। ঘটনা এই যে, আজ সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ইসলামি জিহাদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে— ইসলামি জিহাদিরাই! এক দিকে অস্ত্র ধরেছে আল কায়দা, অন্য দিকে হিজবুল্লা! জিহাদিরা তো বিশ্বময় এক ইসলামের প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই দেখে, তাই নয় কি? জিহাদিরা নিজেরাও তো সেই রকমই প্রচার করে? কিন্তু না, সিরিয়া দেখিয়ে দিল, জিহাদের ইতিহাস-ভূগোলও নতুন করে লেখা দরকার। এবং রাজনীতি। |
|
এ বার এক সূত্রে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের সমর্থকদের হাতে আসাদ ও লেবাননের
হিজবুল্লা নেতার ছবি, ইজরায়েলের পতাকায় ধরানো হচ্ছে আগুন। ছবি: রয়টার্স। |
আল কায়দা ও হিজবুল্লার পরিচয় নতুন করে দেওয়ার নেই। কেবল এইটুকুই নতুন কথা যে, অনেক দিন ধরে সতর্কবাণীতে কান না দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বড় ভুল করে ফেলেছিল, এখন বিস্মিত অসহায়তায় তাকে স্বীকার করতে হচ্ছে, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কেবলই প্রেসিডেন্ট আসাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত নাগরিক নয়, তাদের সঙ্গে আল কায়দার যোগ অতি ঘনিষ্ঠ, চেচনিয়ার জঙ্গিদের যোগও। অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে জঙ্গি যোদ্ধাদের সরবরাহও আসছে আল কায়দা ও চেচেন জঙ্গিদের কাছ থেকে। উল্টো দিকে, প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে হিজবুল্লার ভয়াবহতাও আমাদের পরিচিত। ইজরায়েলের সীমান্ত বরাবর সক্রিয় লেবাননের এই জঙ্গি ইসলামি গোষ্ঠী ইরান ও সিরিয়ার দাক্ষিণ্যে চিরকালই অতি কর্মদক্ষ, সুসংগঠিত। প্যালেস্তাইন দখলের বদলা হিসেবে হিজবুল্লা একা-হাতে ইজরায়েলে কত প্রাণহানি ঘটিয়েছে, ইয়ত্তা নেই। আর এখন, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের বাহিনীর ভয়ানক সংঘর্ষে ইরান ও লেবাননের সমস্ত সমর্থন সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হিজবুল্লা, প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষ নিয়ে।
ব্যাপার জমজমাট। এত দিন অবধি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সুচিন্তিত সমর্থন ছিল আসাদ-বিরোধীদের দিকেই, ভাবটা ছিল তিনি ও তাঁর পশ্চিমী বন্ধুরা ‘নিষ্ফলের, হতাশের দলে’, তাই এই পক্ষ-নির্বাচন। এ বার যেই না সেই নিষ্ফল-শিবিরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আল কায়দা, ছবিটা কী দাঁড়াল? সিরিয়ার যুদ্ধের একই দিকে, একই পক্ষে চলে গেল আমেরিকা ও আল কায়দা, হাতে হাত মিলিয়ে তারা এখন সমর্থন করছে বিদ্রোহীদের! হায় জর্জ ডবলিউ বুশ, হায় তাঁর ঐতিহাসিক ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ভাষণ, হায় ৯/১১!
অন্য ভাবে দেখলে অন্য মজা! আমেরিকা এখনও এই সংগ্রামে সরাসরি অবতীর্ণ হয়নি, তাই আমরা এ-ও বলতে পারি— এই যুদ্ধ হল আল কায়দা (আমেরিকার চিরশত্রু) ও চেচেন জঙ্গিদের (রাশিয়ার চিরশত্রু) বিরুদ্ধে হিজবুল্লা-র (ইজরায়েলের চিরশত্রু) যুদ্ধ! এই পরিস্থিতিতে কার দিকে যোগ দেবে আমেরিকা, ইজরায়েল— দুনিয়া রসাতলে গেলেও যারা রণে-বনে-বিংশে-একবিংশে অভেদসম্ভব বন্ধু? যোগ তো দিতেই হবে কোনও একটি পক্ষে, কারণ প্রেসিডেন্ট বুশের আমেরিকাই তো এক দিন বলে দিয়েছিল, সন্ত্রাসের প্রশ্নে কোনও মাঝামাঝি অবস্থান নেই, হয় ওদের পক্ষ নয় আমাদের পক্ষ। সিরিয়ার এই যুদ্ধও সন্ত্রাসেরই যুদ্ধ হয়ে উঠছে ক্রমাগত, বিশেষত যখন শোনা গিয়েছে প্রেসিডেন্ট আসাদের বাহিনী নাকি রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করে ফেলেছে। এ দিকে মাঝখান থেকে গুলিয়ে গুবলেট হয়ে গিয়েছে ‘আমরা-ওরা’টাই: কে যে ‘আমরা’ আর কে যে ‘ওরা’, হিসেব সারতে সারতে শেষে ওরা আর আমরা মিলেই আমরা হয়ে ওরার সঙ্গে লড়তে নেমে এই-ওরা আর ওই-ওরার মাঝখানে ফেঁসে যাওয়ার উপক্রম!
ফেঁসে যাওয়া ছাড়া উপায় কী! সিরিয়ার এই জিহাদি কুরুক্ষেত্রের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফলাফল খুবই গভীর ও সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ঠিক কোন দিকে সেই ফল গড়াবে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। একটা বিষয় কিন্তু প্রখর ভাবে স্পষ্ট। বেগতিক দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ এই রণাঙ্গন থেকে যত দূরে, দূরে, দূরেই যেতে চাক না কেন, এই যুদ্ধে যে পক্ষই জিতুক, আমেরিকার কপালে অপেক্ষা করছে অসীম দুঃখ। সিরিয়ায় যদি প্রেসিডেন্ট আসাদের আসন টিঁকে যায়, তা হলে পশ্চিম এশিয়ায় সিরিয়া-ইরান-লেবানন অক্ষ আগের চেয়ে অনেক জোরের সঙ্গে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধতা করবে, আর হিজবুল্লা নতুন করে বলীয়ান হয়ে উঠে ইজরায়েলের দফা রফা করার চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যে হিজবুল্লার প্রধান নেতা হাসান নাসরাল্লা টিভি-তে ভাষণ দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট আসাদের জয় ও ইজরায়েলের নিপাত: এই তাঁদের যুগ্ম লক্ষ্য। দেখেশুনে যদি এখন প্রেসিডেন্ট আসাদকেই খুশি রাখতে চায় আমেরিকা, সে ক্ষেত্রে আমেরিকার এত দিনের ইরান-নীতি, ইজরায়েল-নীতি, দুটোই অনেকখানি পাল্টাতে হবে, এই মুহূর্তে যা চিন্তাতীত। আর, যদি বিরোধীরাই জেতে? আল কায়দা তবে একটি গোটা দেশের রাশ পেয়ে যাবে স্বগোষ্ঠীর হাতে, এখনও সকলকে এক ছাঁচে ফেলে বিচার করার অভ্যেসটাই হয়তো কাল হয়ে দাঁড়াল। এই মুহূর্তে সিরিয়ার রক্তলাঞ্ছিত ভ্রাতৃদাঙ্গাভূমি সেই কাল-ভ্রান্তির প্রতীক হয়ে উঁচিয়ে উঠছে পশ্চিমের দিকে। |
|
|
|
|
|