অভিযোগ বারবার, তবু বেঁচেছেন কেকেএন মালিক |
অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
তাঁর নামে একাধিক বার প্রতারণার অভিযোগ দায়ের হয়েছিল কলকাতার বিভিন্ন থানায়। কিন্তু পুলিশ নড়ে বসেনি। শেষ পর্যন্ত তাঁর চেক বাউন্সের জেরে ভিন্ রাজ্যের পুলিশ সক্রিয় হওয়ায় তিনি ধরা পড়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, কলকাতা পুলিশের একাংশকে তিনি হাতে রেখেছিলেন। শাসক দলের এক মন্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা উঠে আসছে।
তিনি কলকাতার বাসিন্দা কৌশিককুমার নাথ। নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তাঁর সংস্থার নাম ‘কেকেএন’।
কৌশিক ধরা পড়ার পরে তাঁর নামে বিভিন্ন আদালত ও থানায় নতুন অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ‘এমপিএস’ এর মতো অর্থলগ্নি সংস্থা ছাড়াও ত্রিপুরা ও অসমের ব্যবসায়ীরাও প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন।
প্রতারণার মূলে সর্ষের তেল!
বুধবারই কলকাতা হাইকোর্টে নোটিস দিয়ে কৌশিকের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা প্রতারণার অভিযোগ এনেছে ‘ক্রে ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে একটি সংস্থা। ওই সংস্থার মালিক চঞ্চল রায় জানান, ‘তৃপ্তি’ নামে একটি সর্ষের তেল বাজারে এনেছিল কেকেএন। অপরিশোধিত সর্ষের তেল কিনে তা প্যাকেট করে বিক্রি করতেন কৌশিক। ওই কাঁচা তেল জোগান দিত ক্রে ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রথমে তাদের থেকে রোজ কয়েক হাজার টাকার তেল কিনতেন কৌশিক, তার দামও মিটিয়ে দিতেন। এ ভাবে বিশ্বাস অর্জন করে ক্রে ইন্ডাস্ট্রিজের থেকে ক্রমশ লক্ষ লক্ষ টাকার তেল কিনতে থাকে কেকেএন। অভিযোগে বলা হয়েছে, এক একটি তেলের ট্যাঙ্কারে ১৫ লক্ষ টাকার সর্ষের তেল ধরে। ক্রে ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক চঞ্চলবাবুর বক্তব্য, “বছর দুয়েক চলার পরে অবস্থা এমন দাঁড়ায়, প্রতি দিন তিন ট্যাঙ্কার অর্থাৎ ৪৫ লক্ষ টাকার তেল কিনত কেকেএন।” |
ক্রে ইন্ডাস্ট্রিজের অভিযোগ, এক বার পরপর পাঁচ দিন তেল নিয়েও টাকা দেয়নি কেকেএন। চঞ্চলবাবুর দাবি, ২০১২ সালের ১৬ জুন বেলঘরিয়া থানায় তাঁরা সমস্ত ঘটনা জানিয়ে অভিযোগ করলেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
বিনা পয়সায় হাতানো এই তেলই কৌশিক অসম ও ত্রিপুরার ডিস্ট্রিবিউটর ধরতে কাজে লাগান বলে অভিযোগ। এখানেও একই ছক। প্রথমে খোলাখুলি ব্যবসা করে ডিস্ট্রিবিউটরদের আস্থা অর্জন। এর পর আরও বেশি ছাড় এমনকী গাড়িরও লোভ দেখিয়ে তাঁদের থেকে অগ্রিম টাকা তোলা। অসমের ১৪ জন ডিস্ট্রিবিউটরের অভিযোগ, এ ভাবে কেকেএন প্রায় ৫ কোটি টাকা প্রতারণা করেছে।
অসমের নলবাড়ির ব্যবসায়ী অনিল জৈন বলেন, “বিশেষ ছাড় দেওয়ার নাম করে আমাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা তুলেছে কেকেএন। এমন ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল যে, ভরসা করে টাকা দিই। পরে যে চেক দেওয়া হয়, তা-ও বাউন্স করে। তিন মাস আগে ওর (কৌশিক) নামে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও কলকাতার পুলিশ ওকে ধরেনি।”
আগরতলার মাঠচৌমনি এলাকার ‘পোদ্দার ট্রেডার্স’-এর মালিক জয়দীপ পোদ্দারেরও অভিযোগ, ২৪ এপ্রিল ভবানীপুর থানায় কৌশিকের নামে অভিযোগ জানানো হলেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি বলেন, “আমার কাছ থেকে ৯০ লক্ষ টাকা নিয়েছিল কৌশিক। আর ফেরত দেয়নি।”
কৌশিকের তেল ব্যবসার সঙ্গে লেনদেনে যুক্ত অসম ও ত্রিপুরার ডিস্ট্রিবিউটররা বিভিন্ন আদালতে ও থানায় কৌশিকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন। জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরে অসমের গোয়েন্দারা কৌশিককে ধরতে কলকাতায় আসেন। অসম পুলিশের এক কর্তা বলেন, “আমরা অনেক বার কৌশিককে ধরতে কলকাতা গিয়েছিলাম। ওকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। ও পলাতক বলেই জানিয়েছিল কলকাতা পুলিশ।”
কেন কৌশিককে এত দিন ধরেনি কলকাতা পুলিশ? তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন, গ্রেফতারি এড়াতে বেশ কয়েক জন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতেন তিনি। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ অবশ্য বলেন, “উনি আগেই ধরা পড়েছিলেন। তবে এ বারও কলকাতা পুলিশই তাঁকে ধরেছে।”
অভিযোগ, ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক ছিল কৌশিকের। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, কৌশিকের প্রধান অফিসের বাইরের ঘরের দেওয়ালে লাগানো ছিল মদনবাবু ও কৌশিকের ছবি। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে মদনবাবুকে নিজের হাতে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন কৌশিক।
মদনবাবু অবশ্য তাঁর সঙ্গে কৌশিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে কৌশিককে আমি চিনতাম না। যত দূর মনে পড়ছে, গত বছর কেকেআর-এর আইপিএল জয়ের দিন সিএবি-র অডিটোরিয়ামে সবাইকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছিলাম। সেই সময়ে উনি আমার কাছ থেকে মিষ্টিমুখ করে থাকতে পারেন। সেই ছবিই তুলে রাখতে পারেন। এ রকম বহু অনুষ্ঠানে অনেকেই আমাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চান। তাঁদের সবাইকে আমরা চিনি, এমন নয়। আমার সঙ্গে তো বেবেতো, মেসি বা সচিন তেন্ডুলকরেরও তো ছবি রয়েছে।” মন্ত্রী আরও বলেন, “এখন এই সব ঘটনা আমাদের অনেক সতর্ক করে দিয়েছে। এখন বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে দেখা করার ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট সতর্ক।”
|