|
|
|
|
সর্বনাশা মাদকের রমরমা |
প্রচুর মুনাফা, ঝুঁকি নিয়েই চলছে গাঁজা ও পোস্ত চাষ |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর
অভিজিৎ চক্রবর্তী • মেদিনীপুর |
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় রমরমিয়ে চলছে মাদকের বেআইনি কারবার। বিষয়টি অজানা নয় প্রশাসনের পদস্থ কর্তাদেরও। অভিযোগ, এতে তাদের মদত রয়েছে। তাই শত তল্লাশি, ধরপাকড়েও চোলাই মদ থেকে গাঁজা, চরস, হেরোইনে রমরমা আটকানো যাচ্ছে না।
প্রথমেই ধরা যাক গাঁজা ও পোস্তর কথা। ধান, আলুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেআইনি এই চাষ বাড়ছে। বাড়তি মুনাফার আশায় অসাধু কারবারিদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন চাষিরা। সব জেনেও নীরব আবগারি দফতর। দু’-চার বার তল্লাশি অভিযান হয়েছে বটে। কয়েকবার গাছ উপড়ে পুড়িয়েও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বেআইনি এই কারবারে জড়িতদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে, বেআইনি এই চাষের রমরমাতেও দাঁড়ি পড়েনি। আবগারি দফতর অবশ্য উল্টো কথা বলছে। দফতরের ‘নার্কোটিক কন্ট্রোল’ বিভাগের যুগ্ম-কমিশনার অমিতাভ সিংহের দাবি, “আমরা উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে বেআইনি চাষের তথ্য সংগ্রহ করেছি। ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এতে বেআইনি চাষ অনেকটাই কমছেও।”
মাদকের কারবার ঠেকাতে কঠোর আইন (এনডিপিএস) রয়েছে। এই আইনে অভিযুক্তের সর্বোচ্চ ২০ বছর জেল ও ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। চাষিদেরও এ সব অজানা নয়। তবু অধিক মুনাফার লোভে বেআইনি এই চাষ করে চলেছেন অনেকে। এই চাষের সব থেকে সুবিধা হল এতে কোনও খরচ নেই। শুধু জমি থাকলেই হবে। বীজ, সার থেকে চাষের যাবতীয় খরচ ব্যবসায়ীরাই দেয়। চড়া দামে ফসলও কিনে নিয়ে যায় তারা। ফলে, বিক্রির জন্য হাপিত্যেশ করে বাজারে ঘুরতে হয় না। হিসেবমতো এক পূর্ণবয়স্ক গাঁজা গাছে প্রায় ৫০০ গ্রাম গাঁজা হয়। একটি গাছ লাগাতে ১৫ বর্গফুট জমি প্রয়োজন। এক ডেসিমেল জমিতে ৩০টি গাছ হয়। ফলন হয় কম করে ১০ কেজি। কখনও কখনও ১৫ কেজি গাঁজাও হয়। মাঠেই কেজি প্রতি সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দাম মেলে। অর্থাৎ ১০ কেজি ফলনে প্রতি ডেসিমেল জমিতে কমপক্ষে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। ভাল ফলন হলে ডেসিমেল প্রতি ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। আষাঢ় থেকে শ্রাবণের মধ্যে গাছ লাগানো হয়। পৌষ মাসে গাছ বড় হয়। অর্থাৎ এই চাষে ৬ মাস লাগে। এর জন্য চাষির খরচ হয় বড় জোর ৫ হাজার টাকা। চাষের সরঞ্জামও পৌঁছে দিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। |
|
শালবনিতে পোস্ত চাষ। —নিজস্ব চিত্র। |
পোস্ত চাষ হয় আলু চাষের সময়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য অনেক বেশি পরিচর্যা লাগে। এক একটি গাছ থেকে রজনীগন্ধার মতো ৩-৪টি ডাঁটি বেরোয়। এই ডাঁটিতে ফুল ও ফল হয়। ফুল থেকে ফল বেরোনোর সময় নিপুণ হাতে ফল ও ফুলের মাঝখান চিরে দিতে হয়। সেই চেরা অংশ থেকে যে আঠালো রস বেরোয় তা থেকে আফিম-নানা ধরনের মাদক তৈরি হয়। আর ফলের ভেতরে থাকে পোস্ত। পোস্তর খোলও মাদক তৈরিতে লাগে। ৭৫-৮০ দিন সময় লাগে এই চাষে। বিঘা প্রতি খরচ ২০-২৫ হাজার টাকা। আর লাভ হয় প্রায় ১ লক্ষ টাকা। কাঠা প্রতি আঠালো রস সংগ্রহের জন্যই ৩ হাজার টাকা পাওয়া যায়। খোসা-সহ পোস্ত হয় কাঠা প্রতি ১০-১৫ কেজি। যার দাম কেজি প্রতি আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা।
জেলায় সব থেকে বেশি গাঁজা চাষ হয় সবংয়ে। আবগারি দফতর সূত্রে খবর, মুরারিচক, বিহারিচক, কালীদহচড়া, লাঙ্গুল, শিউলিপুর, আমড়াখালি, জানকীবাড়, গোবিন্দপুর, বিত্তমা, পেরুয়া, গুণ্ডুৎ-সহ সবংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় একরের পর একর জমিতে গাঁজা চাষ হয়। এছাড়াও কেশপুরের ইল্লাগড়, দাদপুর, কাপাসটিকরি, চন্দ্রকোনা টাউন থানা এলাকার সীতারামপুর, গোপীবল্লভপুরের সাৎমা, নয়াগ্রামের যাদবপুরে এই চাষ হয় রমরমিয়ে। সব থেকে বেশি পোস্ত চাষ হয় গোয়ালতোড়ে। স্থানীয় বাঁশডিহা, কুসুমডহরি, মৌলাড়া, পাথরবেরিয়া, ফুলমণিপুর, নাগরা, বাসুদেবপুর, শেরমণিপুর, নেড়াশোল, মাইতা এই চাষের জন্য বিখ্যাত। গড়বেতার দলদলি, ভুলা, চন্দ্রকোনা টাউন থানা এলাকার যশবন্তপুর, কেশপুরের সাহসপুর, কানাশোলেও চাষ হয়।
প্রত্যন্ত যে সব জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত সেখানেই এই চাষ হয়। যাতে সহজে কারও নজরে না পড়ে। প্রশাসনিক কর্তাদের অবশ্য এ সব অজানা নয়। তবু তল্লাশি হয় না কেন? চাষিদের সোজাসাপটা জবাব, “যাঁরা তল্লাশি করবেন, তাঁদের জানিয়েই এই চাষ করা হয়। লাভের একটা বড় অংশ তাঁদের কাছেও যায়। পুলিশ, আবগারি দফতর থেকে রাজনৈতিক নেতা সকলকে ‘ম্যানেজ’ করার দায়িত্বও নেয় ব্যবসায়ীরাই!” তল্লাশি হলে লোক দেখানো গাছ উপড়ে ফেলা হয়। কখনও পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু চাষির পিছনে থাকা অসাধু কারবারিদের শাস্তি হয় না।
আবগারি দফতরের যুক্তি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জানা যায় না কার জমিতে বেআইনি এই চাষ হচ্ছে। স্থানীয় মানুষ মুখ খুলতে চান না। জমির মালিককে ধরতে হলে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের সহায়তা লাগে। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় জমির হাতবদল হয়ে গিয়েছে। কোথাও বা খাস জমি দখল করেই চলছে গাঁজা বা পোস্ত চাষ। যদিও অভিযোগ, এ সবই হালকা যুক্তি। আসলে প্রশাসনের একাংশের মদতেই বেআইনি এই চাষের বাড়বাড়ন্ত। |
|
|
|
|
|