গায়ে একটা পাতলা শাড়ি কোনও মতে চাপা দেওয়া। হাতে বেঁধানো স্যালাইনের সূঁচ, মুখের বেশির ভাগটা ব্যান্ডেজে ঢাকা। গত তিন-চার দিন গোঙানি ছাড়া আর কোনও শব্দ বেরোয়নি সেই মুখ থেকে। অসহায় দৃষ্টি সারাক্ষণ কড়িকাঠে আটকে। কেউ দেখতে এলে চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
ভিড়ে ঠাসা, প্রায়ান্ধকার ওয়ার্ডের এক কোণে পড়ে রয়েছে পনেরো বছরের রৌশনারা খাতুন!
অভিভাবকদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে পড়তে চাওয়ার মাসুল ওকে দিতে হয়েছে পুড়ে গিয়ে। পুরুলিয়ার বীণা কালিন্দি-সঙ্গীতা বাউড়ি-আফসানা খাতুন কিংবা দক্ষিণ ২৪ পরগনার হাবিবা খাতুনের মতো নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধ এবং শিক্ষা প্রসারের প্রচারে অনায়াসে পশ্চিমবঙ্গের ‘মুখ’ হয়ে উঠতে পারত হুগলির খানাকুলের যে প্রতিবাদী কিশোরী, এসএসকেএমের নিউ ক্যাজুয়ালটি ব্লকে তার ঠাঁই হয়েছে চূড়ান্ত অবহেলায়। মঙ্গলবার সকাল থেকে ঘন ঘন জ্বর আসছে। মাঝে-মধ্যে খিঁচুনি। সরকারি প্রতিনিধি তো দূর, কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও রৌশনারা বা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
বীণা-সঙ্গীতা-আফসানা-হাবিবারা বিয়ে ঠেকাতে সরাসরি থানায় পৌঁছে গিয়েছিল। রৌশনারা সেই সুযোগ পায়নি। গত বৃহস্পতিবার ভোরে খানাকুলের কাঁটাপুকুর গ্রামে নিজের বাড়িতে পুড়ে যায় পাতুল গণেশবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রীটি। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাকে প্রথমে আরামবাগ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শনিবার রেফার করা হয় এসএসকেএমে। বহু চেষ্টাচরিত্র করে মঙ্গলবার বিকেলে ফ্রি বেডের ব্যবস্থা একটা হয়েছে বটে, তবে স্রেফ ওটুকুই। বার্ন ইউনিটে বেড না-মেলায় সংক্রমণের আশঙ্কা যেমন থাকছে, তেমন উঠে আসছে টাকাকড়ির সংস্থানের প্রশ্নও। কী রকম? |
ডাক্তারেরাও মানছেন, পোড়ার চিকিৎসায় যে ধরনের ওষুধ, দামি অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি দরকার, বহু সময়ে হাসপাতালে তার সরবরাহ থাকে না। এমনকী, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রেও তা বাড়ির লোকজনকে কিনে দিতে হয়। এ দিকে রৌশনারার গায়ে আগুন দেওয়ার অভিযোগে বাবা, সৎ মা, সৎ দিদিমা আপাতত হাজতে। কাকা-জ্যাঠা নিজেদের সংসার নিয়ে হিমসিম। তা-ও আত্মীয়-পড়শিরা মিলে ধার-দেনা করে কোনও মতে চার হাজার টাকার ওষুধ কিনে দিয়েছেন। কিন্তু ওঁদের সকলেরই দিন-আনি-দিন-খাই দশা।
ওঁরা কত দিন টানবেন?
শেষ পর্যন্ত কে দাঁড়াবে রৌশনারার পাশে?
এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর এখনও কোনও মহল থেকে মেলেনি। সরকারের তরফে মিলেছে শুধু আশ্বাস। রৌশনারার দিকে রাজ্যের সাহায্যের হাত এগিয়ে গেল না কেন, তার জবাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র এ দিন বলেন, “আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে গিয়ে মেয়েটি ও তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করব। যা যা করার, করব। রৌশনারার দায়িত্ব তো সরকারেরই নেওয়া উচিত।”
কিন্তু দেহের অন্তত ৬০% পুড়ে যাওয়া সত্ত্বেও বার্ন ইউনিটে রৌশনারার ঠাঁই হল না কেন? যেখানে আগুনে পোড়া রোগীদের সংক্রমণের ভয় সবচেয়ে বেশি?
এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: বার্ন ইউনিটে শয্যা নেই। তাই বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে নিউ ক্যাজুয়ালটিতে রাখা হয়েছে। বস্তুত এমনটা হামেশাই হয় বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। যদিও তাতে আশঙ্কার মাত্রা কমছে না। এ দিন দেখা গেল, নিউ ক্যাজুয়ালটি ব্লকে অহরহ বাইরের লোকের আনাগোনা। যে যখন খুশি, জুতো পরে ঢুকছে-বেরোচ্ছে। দিব্যি খাওয়া-দাওয়া চলছে ওয়ার্ডের ভিতরে। চার দিকে রোগিণীদের আত্মীয়-স্বজনের থিকথিকে ভিড়। রৌশনারার পড়শি মহম্মদ সালেকিম বললেন, “পোড়ার জ্বালায় মেয়েটা ছটফট করছে! শুনেছিলাম, পোড়ার ওয়ার্ডে ঠান্ডা মেশিন থাকে। কিছুই নেই! উল্টে ধুলো-ময়লায় ভর্তি!”
যে চিকিৎসকের অধীনে রৌশনারা ভর্তি, সেই অরিন্দম সরকার জানতেন না, এই রৌশনারাই সেই ‘বিদ্রোহী’ মেয়ে। এ দিন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধির কাছে তার পরিচয় জেনে অরিন্দমবাবু বলেন, “খবরের কাগজে পড়েছিলাম। কিন্তু এ-ই যে সে মেয়ে, জানতাম না। আমাদের সকলের ওর পাশে দাঁড়ানো উচিত।” একান্তই যে সব ওষুধ হাসপাতালে মিলবে না, ওঁরা ডাক্তারেরা মিলে তা জোগাড় করার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়ে অরিন্দমবাবুর মন্তব্য, “এমন মেয়েকে বাঁচিয়ে তোলা আমাদের সকলের দায়িত্ব।”
স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠিনী থেকে শুরু করে পরিজন, প্রতিবেশি সকলেই বলছেন, রৌশনারা পড়াশোনা করতে বড্ড ভালবাসত। কিন্তু কেউ এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না যে, সেই ভালবাসার মূল্য ওকে এ ভাবে চোকাতে হবে। কাকা নুরুল ইসলামের আক্ষেপ, “এখন ও আর কোনও কথা বলছে না। শেষ যা বলেছিল তা হল, আমার সঙ্গে কেন এমন হল?”
শূন্য দৃষ্টি মেলে এখনও বুঝি তারই উত্তর খুঁজে যাচ্ছে প্রতিবাদের ‘জ্বলন্ত’ দৃষ্টান্ত রৌশনারা খাতুন।
|