দণ্ডদাতা কাঁদে যবে দণ্ডিতের সাথে, সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। লিখেছিলেন নোবেলজয়ী কবি।
নিগৃহীত মিলায় হাত যবে নিগ্রহকারীর সাথে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে দল! কটাক্ষ এবং সহাস্যে বলছেন তৃণমূলের এক নেতা!
কারণ? টেবিলের দু’পারে বসে মঙ্গলবার এক নিগ্রহকারী এবং নিগৃহীত সমঝোতা করে নিলেন। নিগৃহীতের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁরই সংগঠনের অনুগামী হিসাবে নাম লেখালেন নিগ্রহকারী। এই মধুরেণ সমাপয়েৎ করতে গিয়ে প্রকট হয়ে উঠল শাসক তৃণমূলের অন্দরের বিবাদই!
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের দলেরই কর্মীদের হাতে নিগৃহীত হয়ে বিচারের দাবিতে দলে দীর্ঘ দিন সরব ছিলেন প্রবীণ নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। সেই ঘটনার মূল অভিযুক্ত মন্মথ বিশ্বাস মঙ্গলবার বিধানসভায় সরকারি মুখ্য সচেতকের দফতরে গিয়ে শোভনদেবের কাছেই ক্ষোভ উগরে দিলেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন ও শিক্ষা সেলের নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে! তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মত্যাগ’কে তৃণমূলেরই একাংশ হাইজ্যাক করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করে শোভনদেবও কাছে টেনে নিলেন ক্ষমাপ্রার্থীদের! শিক্ষা ক্ষেত্রে দোলা সেনদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়ে গেল! |
সন্ধি-বৈঠক। তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে
তাঁকে নিগ্রহে অভিযুক্ত মন্মথ বিশ্বাস। ছবি: সন্দীপন চক্রবর্তী। |
বিধানসভায় শোভনদেবের দফতরে এ দিন তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্মথ এবং যাদবপুরের তৃণমূল কর্মী নারায়ণ চক্রবর্তী বিবরণ দিয়েছেন, তৃণমূল ভবন থেকেই নির্দেশ পেয়ে কী ভাবে কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে সরকারি মুখ্য সচেতকের সভা ভণ্ডুল করতে যেতে হয়েছিল! কী ভাবে ‘সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতি’ সিপিএম থেকে আসা লোকজনকে মাথায় বসিয়ে তৃণমূলের পুরনো আন্দোলনকারীদের কোণঠাসা করে ফেলছে। যাঁদের আচরণের বিরুদ্ধে কয়েক মাস আগে শহরের রাজপথে মিছিল করেছিলেন শোভনদেব অনুগামীরা, এ দিন তাঁদেরই মুখের কাহিনী শুনে দুঃখে মাথা নেড়ে গিয়েছেন সরকারি মুখ্য সচেতক। আর দলের গোষ্ঠী-বিবাদের রকম-সকম দেখে আফশোসে দীর্ঘশ্বাস পড়েছে তৃণমূলের ইতিউতি!
মন্মথদের দাবি, তাঁদের সঙ্গে অন্তত ১৮০ জন অশিক্ষক কর্মী ওই সমিতির কাজে ক্ষুব্ধ হয়ে বিকল্প পথ ভাবছেন। বিকল্পের জন্য তাঁদের ভরসা আবার শোভনদেবই! তাঁদের অভিযোগের তির আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা, রাজ্যের দুই মন্ত্রী এবং তৃণমূলের শিক্ষা সেলের এক প্রভাবশালী নেতার দিকে।
সন্ধি-বৈঠকের পরে শোভনদেব বলেছেন, “মন্মথ-নারায়ণেরা বলতে এসেছিল যে, শিক্ষাবন্ধু সমিতির কাজে অশিক্ষক কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সিপিএম লাভবান হচ্ছে। এখানে তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।” কিন্তু যাঁরা তাঁকে নিগ্রহ করেছিলেন, তাঁদের তিনি কাছে টেনে নিলেন? প্রবীণ শ্রমিক নেতার জবাব, “ও ক্ষমা চেয়েছে। আমি ওর চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আমরা তো কেউ দানব নই! আমাদের জয়-পরাজয়ও বড় কথা নয়। আসল কথা হল, যা চলছে, তাতে দলের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।” আর মন্মথবাবুর মন্তব্য, “পিতৃস্থানীয় শোভনদা’র সুযোগ্য নেতৃত্বে ভাল সংগঠন গড়ে তুলতে চাই। শিক্ষাবন্ধু সমিতির ভূমিকায় সিপিএম সুবিধা পাচ্ছে এবং তৃণমূলের পুরনো সৈনিকদের অপমান করা হচ্ছে। তৃণমূল নেত্রীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে কোনও ভাবেই থাকতে পারছি না!”
নাটকের যবনিকা কিন্তু এখানেই নয়! রাজ্যের শ্রম কমিশনারের কাছে গিয়ে শোভনদেব এবং আর এক তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহ এ দিন যে অভিযোগ জানিয়ে এসেছেন, তাতেও শাসক দলে চাঞ্চল্য! শোভনদেবের অভিযোগ, খড়দহের লুমটেক্স জুটমিল খোলা নিয়ে শ্রম কমিশনারের কয়েক ঘণ্টার নোটিসে ডাকা বৈঠকে তাঁর নেতৃত্বাধীন সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে এবং ‘কাগজ চুরি’ করে প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন দোলারা! তবে দোলা এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “সংগঠনের বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে কিছু বলব না। আমার যা বলার, সংগঠনেই বলব।” যদিও সংগঠনে দোলা-ঘনিষ্ঠদের দাবি, ২০১০ সালে দোলার উদ্যোগেই বন্ধ লুমটেক্স খুলেছিল। এখনও সেখানে দোলার নেতৃত্বাধীন আইএনটিটিইউসি-র সংগঠনই রয়েছে।
লুমটেক্স কর্তৃপক্ষের তরফে মিলের ম্যানেজার মৃণাল চক্রবর্তীর বক্তব্য, “শ্রম কমিশনারের নির্দেশে অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আইএনটিটিউসি-র সভানেত্রী দোলা সেনকেও ডাকা হয়। স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক নির্মল ঘোষও ছিলেন। সকলের উপস্থিতিতেই চুক্তি হয়েছে। সোমবার থেকে কাজও চালু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মিলটি ফের বন্ধ করতে তৃণমূলের একাংশ অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে।”
তৃণমূল বনাম তৃণমূল চলছে। মাঝে মাঝে মিলে যাচ্ছে নিগৃহীত আর নিগ্রহকারীদের শিবির!
|