|
|
|
|
সুনীল সম্রাট নিঃসঙ্গতা |
আগামী অক্টোবরে তাঁর ১২৫ বছর। সেই শিশির ভাদুড়ি-কে নিয়ে সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ এ বার মঞ্চে। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
তাঁর মৃত্যুর ক্ষত এখনও শুকোয়নি। গত অক্টোবরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর যে এখনও বছর ঘোরেনি।
তিনি, শিশির ভাদুড়ি মারা গিয়েছেন ১৯৫৯ সালে। এ বারেই ওঁর ১২৫ বছর। অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্রসদন, গিরিশ মঞ্চ-অধ্যুষিত কলকাতা কী করবে, পরে জানা যাবে। শিশির ভাদুড়ি অবশ্য ওই সব করা-টরার জন্য বিন্দুমাত্র লালায়িত ছিলেন না। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এবং পুত্রকে বলে গিয়েছিলেন, একগাছা মালার জন্য তাঁর মরদেহ যেন কোনও থিয়েটার হলে নিয়ে যাওয়া না হয়। পরে তাঁর নামে একটি মঞ্চ তৈরি হল, সেখানে নাটক থেকে জলসা থেকে ফিল্মোৎসব সবই হতে থাকল। সে অন্য ব্যাপার।
সেই শিশির ভাদুড়ি এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ বার একসঙ্গে বাঁধা পড়ছেন। আগামী ২২ জুন, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। স্টার থিয়েটারে।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে, ২০০৫ সালে শিশির ভাদুড়িকে নিয়ে ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ নামে উপন্যাস লিখেছিলেন সুনীল। এ বার ‘পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ’ দলের প্রযোজনায় সেই উপন্যাস অবলম্বনে নাটক। নাট্যরূপ এবং পরিচালনায় ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’খ্যাত দেবেশ চট্টোপাধ্যায়।
নাট্যরূপের অনুমতিটি দিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং লেখক। জীবদ্দশায় এটিই তাঁর শেষ নাট্যরূপের অনুমতি। এক সন্ধ্যায় লেক ক্লাবের আড্ডায় দেবেশ কিছুটা বাধো-বাধো ভঙ্গিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘সুনীলদা, ওই উপন্যাসটা যদি নাটক করতে চাই?’ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল লেখকের মুখ, ‘বলো কী? ওটা নাটক হয়? কে করবে? তুমি?’ ঘটনার কয়েক মাস আগে দেবেশের পরিচালনায় মিনার্ভা রেপার্টরিতে ‘দেবী সর্পমস্তা’ নাটক নেমেছে। আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর ধারাবাহিক কলমে সেই নাটকের প্রশংসাও করেছেন সুনীল।
|
|
|
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
শিশির ভাদুড়ি |
|
‘ওটা নাটক হয়?’ সংশয়ের পিছনে নানা কারণ ছিল। উপন্যাসে ১৯৩০ সালে নিউ ইয়র্কে ‘সীতা’ নাটক নামার কথা আছে, কঙ্কাবতীর সঙ্গে শিশির ভাদুড়ির প্রেমের অনন্য বর্ণনা আছে। দু’ জনে মোটরগাড়িতে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছেন। আকাশে ঝড় উঠেছে, তরুণী কঙ্কাবতীকে শিশির রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনাচ্ছেন, ‘আমারে যে ডাক দেবে, এ জীবনে তারে বারংবার ফিরেছি ডাকিয়া।’ উপন্যাসে এই ছবিগুলি আঁকা যায়, কিন্তু মঞ্চে? এবং সেই নাটক যদি হয় শিশির ভাদুড়িকে নিয়ে? যিনি আধুনিক বাংলা নাটকের অন্যতম পথপ্রদর্শক?
১২৫ বছরে পথপ্রদর্শক কথাটা ব্যাখ্যা করা দরকার। আপনার-আমার ঘরের ছেলেমেয়েরা আজ যে নাটকে অভিনয় করার জন্য ভিড় করেন, এটি শিশির ভাদুড়ি না থাকলে হত না। তাঁর আগে বাংলা নাটকে গিরিশ ঘোষ, দানীবাবুর মতো অভিনেতা ছিলেন, সত্য। কিন্তু শিশির ভাদুড়ি ইংরেজির ডাকসাইটে ছাত্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সকলে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে পেশাদারি মঞ্চে আসছেন। এই জিনিস আগে কখনও হয়নি।
এই শিক্ষিত মননই বদলে দিল সব কিছু। তাঁর আগে, বাংলা নাটকে সেট বা মঞ্চসজ্জা বলে কিছু ছিল না। পিছনে ছবি-আঁকা পর্দা ঝোলানো থাকত, অভিনেতা পার্ট আউড়ে যেতেন। শিশিরবাবুই নিয়ে এলেন ত্রিমাত্রিক সেট, আলোর যথাযথ ব্যবহার। সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে এই যে বারংবার ঝালে-ঝোলে-অনুদানের মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ ভেসে উঠছেন, সেই রবীন্দ্রনাটককে পেশাদারি মঞ্চে প্রথম নিয়ে আসেন শিশির ভাদুড়ি। তাঁর পরিচালনাতেই নেমেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘তপতী’ বা ‘শেষ রক্ষা’র মতো নাটক। “তাঁর বাচনে যে পরিশীলন, শোভনতা ছিল, সেটি রবীন্দ্রনাথেরই প্রভাব,” স্মৃতিচারণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের।
আমেরিকার মাটিতে প্রথম বাংলা নাটক, সেটিও শিশিরবাবুর অবদান। কোনও ঘরোয়া সংস্কৃতি সম্মেলন বা প্রবাসী সম্মেলন নয়, ১৯৩০ সালে নিউ ইয়র্কের ভ্যান্ডারবিল্ট থিয়েটারে নেমেছিল ‘সীতা’। তখনকার বিখ্যাত ইম্প্রেসারিও এলিজাবেথ মালবেরি ব্রডওয়েতে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শিশিরকুমারকে। নাটক নানা কারণে ফ্লপ করেছিল। কঙ্কাবতী, প্রভা, তারাকুমার ছাড়া ভাল অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন না, বাঁশি এবং তবলা বাজানোর লোক ছিল না, একা শিশিরবাবু ছাড়া লাইটম্যান এবং ইলেকট্রিসিয়ানকে ইংরেজিতে নির্দেশ বোঝানোর জন্য কেউ ছিল না। ভারত সম্পর্কে তখন মার্কিন ধারণা, ওই দেশে বেশির ভাগই অশিক্ষিত। মেয়েদের তালাচাবি বন্ধ করে ঘরে রেখে দেওয়া হয়। ‘সীতা’ নাটকের মার্কিন বিজ্ঞাপনে বেরিয়ে ছিল, ‘এই প্রথম! ভারতীয় মঞ্চের জাদুকর ও এক দল নাচিয়ে মেয়ে! The wizard of the Indian stage with a band of nautch girls।’ একুশ শতকে আজ ইতিহাস বদলে গিয়েছে, সেই ব্রডওয়েতেই এ আর রহমানের ‘বোম্বে ড্রিম্স’ দেখে লোকে ধন্য ধন্য করেছে। কিন্তু তাঁর যাবতীয় ব্যর্থতা নিয়ে শিশিরকুমার আজও বাংলা তথা ভারতীয় নাটকের সাগরপাড়ির কলম্বাস!
শুধু সাগরপাড়ি নয়। ১৯৫১ সালে, কলকাতার ‘শ্রীরঙ্গম’ (পরে বিশ্বরূপা নামে খ্যাত) মঞ্চে শিশির ভাদুড়ির ‘ষোড়শী’ নাটক দেখতে এসেছিলেন রুশ চলচ্চিত্রকার পুদভকিন ও অভিনেতা চেরকাসভ। কলকাতার ভাঙাচোরা শ্রীরঙ্গমে নাটক দেখে আইজেনস্টাইনের ‘ইভান দ্য টেরিব্ল’ ছবির অভিনেতা চেরকাসভ হাত বাড়িয়ে দিলেন শিশিরবাবুর দিকে, ‘your acting is great. আপনি তো মশাই প্রায় স্তানিস্লাভস্কির সঙ্গে পাল্লা দেন।’ তুমি পুদভকিন, আইজেনস্টাইন যেই হও, নাটক দেখতে হবে কলকাতার ভাঙাচোরা থিয়েটার হলে, এই দেশের আর পাঁচ জনের সঙ্গে। নিজের কাজ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী বৃহৎ বাঙালি তিনি, আর পাঁচ জন গড়পড়তা লোকের সঙ্গে তাঁকে মেলানো যাবে না।
আগামী ২ অক্টোবর সেই আত্মবিশ্বাসী বাঙালির ১২৫। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কয়েক জন শেষ দিকে শিশিরবাবুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দেবেশের নাটকে তরুণ সৌমিত্রের একটি চরিত্রও আছে। শিশিরবাবু তাঁকে ব্রেখটের ‘বিধি ও ব্যতিক্রম’ নাটক অনুবাদ করতে বলছেন। এই তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বেছে নেওয়া হয়েছে রেপার্টরি থেকে। ৬২ জনের অডিশন নিয়েছিল ইন্দ্ররঙ্গ, সেখান থেকে বাছাই ৮ জন। নাটকে শিশির ভাদুড়ির দুটি সত্তা। এক জন প্রৌঢ়ত্বে ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টেনে স্মৃতি রোমন্থন করেন, অন্য জন তরুণ অভিনেতা। দুই চরিত্রেই দেবশঙ্কর হালদার।
|
নাটককে, দৃশ্যপটকে, অভিনয়কে, শব্দকে সব কী করে একসঙ্গে নাট্যের মধ্যে ব্যবহার
করতে হয় তার শিক্ষা আমরা শিশিরকুমারের কাছ থেকেই পেয়েছি। তিনিই আমাদের
প্রথম নির্দেশক। কিন্তু প্রথম বলেই তাঁর অনেক সূক্ষ্ম কারুকাজ তেমন করে
নজরে পড়েনি লোকের, তেমন করে আদর পায়নি
শম্ভু মিত্র |
শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে সংস্কৃতি আয়ত্তগত হয়। বাংলা দেশের সংস্কৃতিতে
শিশিরকুমারের বিপুল দানের অনেকখানিই যে অনায়ত্ত রয়ে গেছে, তার কারণ এই শ্রদ্ধা
ও কৃতজ্ঞতাবোধের অভাব... বাঙালি নাট্যশালাকে প্রমোদভবন হিসাবেই দেখেছে,
জাতীয় সংস্কৃতির মন্দির বলে কল্পনা করেনি
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় |
লেখাপড়ায় মার্কামারা পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলে না হলেও আমাদের কলেজের জীবনে
সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে উজ্জ্বল-মতি, আর চেহারায়ও তেমনই সুদর্শন ছাত্র ছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ি
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় |
|
কেমন ছিলেন শিশির ভাদুড়ি? এক দিকে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য, অন্য দিকে চূড়ান্ত বোহেমিয়ান এবং অভিমানী। যে দিন মদ খেলেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যদের সঙ্গে বোতলের পর বোতল উড়িয়ে দিলেন। চেয়েছিলেন জাতীয় নাট্যশালা, যেখানে দেশের বিভিন্ন ভাল অভিনেতাদের নিয়ে নাটক করা যাবে। সেই আশা পূরণ হল না, পদ্মশ্রী থেকে নাট্য অকাদেমির সভাপতিত্ব সবই প্রত্যাখ্যান করলেন। ‘‘সরকারি খেতাব শুধুই কিছু খয়ের খাঁ তৈরি করবে,’’ বলতেন তিনি।
দেবশঙ্করের অবশ্য এটিই প্রথম ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। এর আগে ‘রুদ্ধসংগীত’ নাটকে তাঁকে দেখা গিয়েছিল দেবব্রত বিশ্বাসের ভূমিকায়। দেবব্রত বিশ্বাসকে অনেকে দেখেছেন, তাঁর হাঁপানির টান, গায়নভঙ্গি এখনও রেকর্ডে ধরা আছে। কিন্তু শিশির ভাদুড়ি? রপ্ত করা যাবে তাঁর বাচন ও চলন? “অভিনেতা তো হরবোলা নয়, যে শিশির ভাদুড়ির নকলে কথা বলতে হবে বা হাঁটতে হবে। আমি চরিত্রটা বিশ্লেষণ করছি, কেন শিশিরবাবু কঙ্কাবতীকে বিয়ে করেন না? শুধুই পুরুষতন্ত্র? সামন্ততন্ত্র? নাকি, তার সঙ্গে মিশে আছে প্রথমা স্ত্রীর আত্মহত্যার স্মৃতি?” বলছিলেন দেবশঙ্কর। তাঁর সঙ্গে কঙ্কাবতীর চরিত্রে রয়েছেন ‘রাজা লিয়ার’খ্যাত সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবশঙ্কর-সেঁজুতির জুটিতে দৃশ্যপট দলের ‘অয়দিপাউস’ এখন অন্যতম হিট নাটক। তাঁদের দ্বিতীয় পদক্ষেপ দেখার জন্য কলকাতা মুখিয়ে।
এই নাটকেই দেবশঙ্করের অগ্নিপরীক্ষা। সমালোচকেরা কেউ কেউ এখন বলতে শুরু করেছেন, অতিরিক্ত অভিনয় ক্রমে দেবশঙ্করের ওপর প্রভাব ফেলছে। যে ভঙ্গিতে ঋষি গালবের অভিনয় করেন, সেই ধাঁচেই গ্রিক অয়দিপাউস সাজেন। ‘রুদ্ধসংগীত’ নাটকের দেবব্রত বিশ্বাসের মতো জীবন্ত হয়ে উঠল না অন্য চরিত্র। এ বার সেই সমালোচকদের চ্যালেঞ্জ আদৌ নিতে পারবেন দেবশঙ্কর? একই সঙ্গে তরুণ ও প্রৌঢ় শিশির ভাদুড়িকে জীবন্ত করে তুলতে পারবেন তিনি? পারলে সেটিই হবে তাঁর কেরিয়ারের উজ্জ্বল উদ্ধার।
রেপার্টরি ধাঁচে প্রযোজনা, ফলে নাটকে ১৮টি গান। দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত। সঙ্গে ‘চন্দ্রবিন্দু’র দ্রোণ আচার্যের আবহ। মঞ্চ পরিকল্পনায় হিরণ মিত্র। “সুনীলের উপন্যাসটা পড়েছি, ওখানে অনেক কিছু ফিকশনালাইজ্ড করা। যাঁরা নাটক করছেন, তাঁরা ফিকশনের পাশাপাশি নাটকের ইতিহাস কতটা ধরলেন, শিশিরবাবুর সময়টা কী ভাবে উঠে এল, সেটি দেখতে আগ্রহী আমি,” বলছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সুনীলের উপন্যাস শেষ হয়েছিল, বন্ধু সুকুমার রায়ের ছেলের সঙ্গে শিশির ভাদুড়ির দেখায়। সত্যজিৎ ‘জলসাঘর’ ছবির জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের পার্ট দিতে চান শিশিরবাবুকে, তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। মঞ্চ-অভিনেতা হয়েই ফুরিয়ে যেতে চান শিশির ভাদুড়ি, ক্যামেরার সামনে পরিচালকের হাতের পুতুল সাজা তাঁর পোষাবে না।
দেবেশের নাটকে সত্যজিতের থেকেও তরুণ সৌমিত্রের ভূমিকা বেশি। এবং সেখানেই শেষ হয় না নাটক। শেষ দৃশ্যে শিশির ভাদুড়িবেশি অভিনেতা দেবশঙ্করের পাশে চলে আসবেন পরিচালক নিজে। বলবেন, ‘চল, নতুন নাটকটা পড়তে হবে।’ সুনীল সত্যজিতে এসে শেষ করেছিলেন, দেবেশ একই নাটকে তিন প্রজন্মকে জুড়ে দিলেন। শিশির ভাদুড়ি, সৌমিত্র এবং দেবশঙ্কর! |
|
|
|
|
|