|
|
|
|
হুল্লোড় |
উদ্যাপন আছে বিহ্বলতা কোথায় |
তিন মেয়ে। পরস্পরের সান্নিধ্যে কখনও উচ্ছল। কখনও প্রাণবন্ত।
কখনও বা প্রাণহীন। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
মৈনাক ভৌমিকের চতুর্থ ছবি ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’-এর প্রথম দৃশ্যের কথা ভাবুন দর্শক। যেখানে শ্রীময়ী (স্বস্তিকা) বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে জিন্স গলাবার চেষ্টা করছে আর তার গোলাপি প্যান্টি পরা উল্টোনো নিতম্বতে সরাসরি চোখ আটকাচ্ছে আপনার। অথচ এই পুরো দৃশ্যটার মধ্যে কোনও বিপদসঙ্কুল যৌন সুড়সুড়ি নেই, যেন হঠাৎ একটা মেয়ের বেডরুমে ক্যামেরা ঢুকে গেলে এ রকম কয়েকটা দৃশ্যের অবতারণা ঘটতেই পারে। যেমন এরই পরের একটা দৃশ্যে আমরা স্বস্তিকাকে জামা তুলে বসে কমোডে প্রাতঃকৃত্য করতে দেখি এবং সেই দৃশ্যের আটপৌরে ভাবটা এমনই যে, না তো আপনি তাতে চমকান, না আপনি লজ্জা পান। অথচ এটা তো ঠিক
যে আজ পর্যন্ত কোনও বাংলা সিনেমায় নায়িকাকে বসে বসে উরু চুলকোতে চুলকোতে পটি করতে দেখা যায়নি। কিন্তু দেখা না গেলেও বাস্তবে তো মেয়েরা লাফিয়ে লাফিয়ে প্যান্টি গলায়, সকালে উঠে পটিও করে। এত দিন কেউ তার চিত্রগ্রহণ করেনি। মৈনাক সেটা করে দেখিয়ে দিলেন।
বাংলা সিনেমার ‘হাইমেন’ পাওলিদাম ‘ছত্রাক’ ছবিতে ছিঁড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাতে একটা আর্তনাদ শোনা গিয়েছিল। তার পর আর পর্দায় তেমন কিছু বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটেনি। মৈনাক একটা বিপ্লব করলেন এবং সেটা করলেন প্রায় নিঃশব্দে এবং ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’-এ মৈনাককে এ ব্যাপারে ক্রমাগত সাহায্য করে গেলেন যিনি, তিনি স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। বলা বাহুল্য, এ সব দৃশ্যে দর্শক আঁতকে উঠলেন না, জাস্ট ‘রিলেট’ করলেন। এই ‘রিলেট’ করতে পারাটা আধুনিক দর্শক বা পাঠকের কাছে সিনেমা বা সাহিত্যের ভালমন্দের অন্যতম ক্রাইটেরিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আজকাল শিল্পের সঙ্গে দূরত্বটা আদৌ পছন্দ করছে না। মানুষ ইদানীং সদা সর্বদাই সিনেমা ও সাহিত্যের কাছে এই কমফর্ট জোনটা দাবি করছে, যেখানে সে আপাদমস্তক নিজেকে ‘রিলেট’ করতে পারে। যে ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ বিষয়গুলো সাধারণ একটা মানুষের জীবনকে শাসন করে, সিনেমা ও সাহিত্যে তার প্রতিফলন দেখলে এই সময়ের মানুষ সম্ভবত অন্য এক রকমের স্বস্তি ও সান্ত্বনা পায়। না তার জীবন কোনও বৃহৎ ও মহৎকে স্পর্শ করতে পারে, না পারে তার সিনেমা ও সাহিত্য। এই ‘রিলেট’ করতে ও করাতে পারার সমীকরণকেই সমকালীনতার প্যারাডক্স বলা হয়। আবর্তনটা একে অন্যের পরিপূরক। |
|
এই সব দিক থেকে বিচার করলে মৈনাক ভৌমিকের ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ একটি সমকালীন ছবি যেখানে ‘গার্লস’ (গাইজ) রক। আর ‘আমি আর আমার গার্লফেন্ডস’-য়ের তিন মেয়ে শ্রীময়ী (স্বস্তিকা), রিয়া (পার্নো), এবং প্রণীতা (রাইমা) এই সময়ের যে কোনও বড় শহরের তিনটি মেয়ে হতে পারে। সে শহর নিউইয়র্ক কিংবা মুম্বই কিংবা কলকাতা। সত্যি বলতে মেট্রো শহরগুলোর মেয়েরা এখন এ রকমই। ঠিক যেমনটি দেখলাম আমরা শ্রীময়ী, রিয়া ও প্রণীতাকে। দেখলাম আর স্বস্তি পেলাম। ‘রিলেট’ করতে পারলাম তাই আর কোনও চ্যালেঞ্জ থাকল না। কমপিটিটিভ পরীক্ষাগুলো ছাড়া, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ছাড়া চ্যালেঞ্জ জিনিসটাকে সমকালীন সমাজ বড় বেশি ঘৃণা করে। তাই ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ নিরীহ ঘটনার পর্যবেক্ষক হয়েই থেকে যায়। শ্রীময়ীর জীবনে এসে পড়ে ষোলো-সতেরোর বালক। শ্রীময়ী তাকে গ্রহণ করে মন, মনন, বেদন, পরিবেদনার তোয়াক্কা না করেই। রিয়া যাকেই দেখে, তার সঙ্গেই বিবাহ করিডরে হাঁটার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। প্রণীতা তথাকথিত চিন্তনশীল (লেখক) হয়েও আশ্রয়প্রার্থী হয় এক এক নামগোত্রহীন চ্যাট ফ্রেন্ডের। শ্রীময়ী, রিয়া, প্রণীতারা গার্লস নাইট আউট করে, কফিশপে বসে ক্লান্ত আড্ডা দেয়, মন্দারমণির বিচে বিকিনি পরে জলকেলি করে। সম্ভবত প্রেম এবং সেক্সহীনতাই তাদের জীবনের একমাত্র বিপন্নতার জায়গা। একমাত্র এই মেয়েরা পরস্পরের সান্নিধ্যে কিছুটা উচ্ছল, কিছুটা প্রাণবন্ত। বাকি সময়টা প্রণীতা কিংবা শ্রীময়ীকে লাগে হতাশ ও প্রাণহীন।
হয়তো মৈনাক এই ছবির মধ্যে দিয়ে সেই বাস্তবতাকেই ধরতে চেয়েছেন যেখানে ক্রমশই মেয়েরা সাহচর্যের জন্য মেয়েদেরই দ্বারস্থ হচ্ছে, ক্রমশ একটা মেয়ে একটা মেয়ের কাছেই খুঁজে পাচ্ছে সহানুভূতিশীল তত্ত্বাবধান। এই আধুনিক পৃথিবীর মেয়েরা ক্রমশই এত মানসিক সাবালকত্ব অর্জন করছে যে পুরুষরা তাদের কাছে সেই তুলনায় হয়ে উঠছে অপরিণত মস্তিষ্ক। খেলার সামগ্রী। ছেলেমানুষ। সেই কারণেই হয়তো শ্রীময়ীর কাছে তার স্বামী এবং হাঁটুর বয়সি ছাত্রের আবেদন একই।
ইদানীং পরের পর বাংলা ছবিতে গালাগালির ছড়াছড়ি। এটা সত্যিই যে আজকাল মেয়েরা যথেচ্ছ স্ল্যাং বলে। যখন খুশি যাকে খুশি খিস্তি করতে এখন ছেলে-মেয়ে উভয়েই পারদর্শী। মেয়েরাও আজকাল গালাগালি দেয় কারণ মেয়েরা কাজ করে। কাজ করতে গেলে প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়তেই হয়। প্রতিবন্ধকতা থেকে তৈরি হয় ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি। এর থেকেই জন্ম নেয় খিস্তিখেউড়। মেয়েরা খিস্তি করছে, মানে মেয়েরা কাব্য করছে, এগোচ্ছে। আমরা হলিউড ছবিতে মেয়েদের কথায় কথায় স্ল্যাং বলতে দেখে ‘মাইন্ড’ করিনি। এখন বাংলা ছবির ক্ষেত্রেও আমরা ‘মাইন্ড’ করছি না। এবং ‘রিলেট’ করছি মুগ্ধ হয়ে!
‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ সব মিলিয়ে বেশ একটা ঝকঝকে স্মার্ট ছবি। এতটাই স্মার্ট যে আমাদের গর্ব হতে পারে। যদিও মৈনাকের ‘বেডরুম’ দেখার পর এই ছবিটার ক্ষেত্রে যে যে প্রত্যাশাগুলো তৈরি হয়েছিল, বলা বাহুল্য ছবিটা প্রত্যাশার সেই উচ্চতায় উঠতে পারেনি। হতে পারে যে ছবিতে এই সময়ের মেয়েদের যৌবনের বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস আর আশা আকাঙ্ক্ষাকে কুর্নিশ করা হয়েছে, উদ্যাপন করা হয়েছে। কিন্তু বিহ্বল হয়ে পড়ার বা মায়াবি মুহূর্ত খুঁজে পাওয়ার একটা ইচ্ছেও তো দর্শকের থাকে।
ছবিতে মৈনাকের নায়িকাদের অভিনয় সম্পর্কে যত প্রশংসাই করা হোক, কম। স্বস্তিকার অভিনয়ের নির্যাসে শ্রীময়ী চরিত্রটি একটা তুলনাহীন চরিত্র হয়ে থাকবে বাংলা সিনেমায়। একটু সরল, একটু বোকা, যখন তখন প্রেমে পড়তে চাওয়া পার্নো (রিয়া) যেন ভীষণ চেনা!
রাইমা ধীরে ধীরে আরও বিশ্বাসযোগ্য ও গভীরমনস্ক অভিনেত্রী হয়ে উঠছেন। সংশয়াতীত ভাবে যিনি নিজের অভিনয় দিয়ে এই সমকালীনতাকে অন্য এক মাত্রা দিয়ে গেলেন, তিনি বিশ্বনাথ।
মৈনাকের চিত্রনাট্য অতি বুদ্ধিদীপ্ত, প্রগলভ, বিপুল রূপে চলমান।
ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, পরিহাসমুখর, জমজমাট ছবি। ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’-এর ক্যামেরাও ততখানি স্বতঃস্ফূর্ত। নীল দত্তের মিউজিকেও এই সময়ের ডামাডোলের প্রভাব। সদর্থেই এই সময়ের মেয়েদের নিয়ে নিজের মতো করে একটা সেলিব্রেশনই ঘটিয়েছেন মৈনাক। পর্দায়। দর্শক সেই সেলিব্রেশনের অংশ হতেই পারেন। |
|
|
|
|
|