তিন গার্লফ্রেন্ড। ‘ভাল বাসার’ খোঁজে পরিবার থেকে দূরে, কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে শুরু করেছিলেন নতুন জীবন। তাদের কেউ বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে থাকত। পাশে থাকত প্রিয় গিটারটা। কেউ কল সেন্টারে কাজ সেরে ফিরত। রান্নাবান্নাও করত নিজেরাই। দু’জন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে সদ্য, আর এক জন পড়ছে দ্বাদশ শ্রেণিতে।
রবিবার ভোরে পুলিশ কড়া নাড়ল ওদের বাড়ি। তিন জনেই জানিয়ে দেয়, বাড়িতে ফিরবে না তারা। ছোটখাট কাজ করে, পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কেন ফিরে যাবে নিত্যদিনের অশান্তিতে? কেন ১৭ বছরে স্কুল ছেড়ে বিয়ে করবে?
তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের কথায়, “প্রথমে ভেবেছিলাম, স্রেফ ছেলেমানুষি করেই ওরা চলে গিয়েছে। পরে পরিষ্কার হল, ঠিক তা নয়। বাড়িতে নিজেদের মতো করে বাঁচতে পারছিল না ওরা।” তাই টালিগঞ্জের মালঞ্চ এলাকায় মাসিক ৬ হাজার টাকায় ঘর ভাড়া নিয়েছিল। উত্তরপাড়া থানার পুলিশ তিন জনকে বাড়ি ফিরিয়ে দেয় রবিবার। |
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
তিন ছাত্রীর মধ্যে পামেলা এবং সুলতানা এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। পামেলার বাড়ি রিষড়ায়। সুলতানা হিন্দমোটরে থাকে। সুদেষ্ণা-ও রিষড়ার বাসিন্দা, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। গত শুক্রবার বিকেল থেকে তারা নিখোঁজ। রিষড়া এবং উত্তরপাড়া থানায় ডায়েরি করেন তাদের বাড়ির লোক। তদন্তে নেমে উত্তরপাড়া থানার আইসি প্রিয়ব্রত বক্সি জানতে পারেন, ওরা টালিগঞ্জ এলাকায় রয়েছে।
তিন বন্ধু জানায়, কয়েক দিন আগে তারা পালানো স্থির করে। রিষড়ায় তাদের পরিচিত বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী এক যুবকের কাছে এ নিয়ে কাকুতি-মিনতি করে তারা। ওই যুবকই মাসিক ৬ হাজার টাকা ভাড়ায় ঘর ঠিক করে দেন। এমনকী প্রথম মাসের ভাড়ার টাকাও তিনি ধার দেন। পুলিশের কাছে সুলতানা জানায়, বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু বিয়েতে তার সায় ছিল না। বিয়ে হলে পড়াশোনায় ছেদ পড়বে, এই আশঙ্কাতেই সে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও এ ব্যাপারে কোনও শিক্ষিকা বা আর কারওকে কিছু জানায়নি মুখচোরা মেয়েটি। সোমবার সে বলে, “আমি বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি। কী হতে চাই সেটা বড় কথা নয়, অনেক পড়তে চাই।” সুলতানার বাবা গাড়ি চালান। তিনি জানান, ভাল পাত্র পাওয়ায় তাঁরা চেয়েছিলেন আপাতত মেয়ের আইনমাফিক বিয়ে সেরে রাখবেন। পরে সামাজিক অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে। তিনি বলেন, “আমরা কখনওই মেয়েকে পড়াশোনা ছাড়তে বলিনি। ও যতদূর পড়তে চায় পড়ুক।” পামেলা জানায়, “কম্পিউটার নিয়ে পড়তে চাই। বাড়িতে থেকে খুব সমস্যা হচ্ছিল।” পারিবারিক অশান্তির জন্য পামেলা যে একাকীত্বে ভোগে, তা স্বীকার করেছেন তার পুলিশকর্মী বাবাও। আর যৌথ পরিবারে বিধবা মায়ের অসম্মান দেখে কষ্ট পাচ্ছিল সুদেষ্ণা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সত্যজিৎ আশ বলেন, “সমাজ যদি অভিভাবকের দৃষ্টিতে দেখে, তবে এই কাজকে বিদ্রোহ মনে হবে। ওই কিশোরীদের দিক থেকে দেখলে কিন্তু ওদের কাজে যথেষ্ট বুদ্ধিগ্রাহ্যতা রয়েছে।” তাঁর বিশ্লেষণ, বাড়ি থেকে পালানোয় নতুনত্ব নেই। কিন্তু তিন বন্ধু একই সমস্যায় ভুগছে বলে একসঙ্গে পরিকল্পনা করে সমাধান খুঁজেছে, নিজেদের একটা জায়গা তৈরি করতে চেয়েছে, এটা ব্যতিক্রমী।
সমাজবিজ্ঞানী রুচিরা গোস্বামীও বলেন, “কলকাতার মতো মেট্রো শহরে তরুণীদের নিজস্ব ‘স্পেস’ তৈরির ধারণা তৈরি হয়েছে। জেলা শহরের কিশোরীদের কাছে তা অতটা প্রত্যাশিত নয়।” ‘অন্তহীন’, ‘বর আসবে এখুনি’, ‘মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর,’ ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না,’ কিংবা সদ্য মুক্তি-পাওয়া ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’-এর মতো ছবিতে অবিবাহিত তরুণীদের স্বাধীন ভাবে শহরে থেকে নিজেদের স্বপ্নের সন্ধান করার বিষয়টি দেখানো হয়েছে। বাংলার বাইরের শহরগুলিতে পড়তে বা চাকরি করতে গিয়ে মেয়েদের নিজেদের মতো থাকাও এখন পরিচিত। এমন নানা আবহই হয়তো জেলার মেয়েদের কাছেও এখন ‘একা থাকা’-কে আর ‘অসম্ভব’ করে রাখেনি, বলেন রুচিরা।
কেমন ছিল এ ক’দিন তিন গার্লফ্রেন্ড? “আমাদের মধ্যে তো কোনও ঝগড়া নেই। তাই বেশ ছিলাম। পড়াশোনা, আড্ডা-কাজ সব মিলিয়ে ভালই লাগছিল। ঠিক করেছিলাম কাজ করে বাড়ি ভাড়া মেটাব। যে দাদা ধার দিয়েছিল, তা-ও শোধ করার পরিকল্পনা ছিল,” বলল পামেলা। আর সুদেষ্ণার কথায়, “অন্য কোথাও থাকব বলে ঠিক করেছিলাম। মা-কে সেটা বলেছিলাম। আমি আইন নিয়ে পড়তে চাই। সব বইপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। নিজের প্রিয় গিটারটাও। আমার বাবা মারা গিয়েছেন। বাড়িতে অশান্তি হলে, মা-কে কেউ খোঁটা দিলে ভাল লাগে বলুন!” (কিশোরীদের নাম পরিবর্তিত) |