কলকাতা হাইকোর্টে আজ, সোমবার নতুন করে লড়াই শুরু হচ্ছে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মধ্যে। উপলক্ষ, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন।
আইনি এই লড়াইয়ের প্রথম ধাপে কমিশন জিতে গিয়েছে। গত শুক্রবার বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সব দাবি মেনেই রায় দিয়েছেন। এবং তার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে রাজ্য সরকার আজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করতে চলেছে। তবে এ বারের লড়াইয়ে প্রেক্ষিতটা পাল্টে গিয়েছে। সিঙ্গল বেঞ্চের মামলায় কমিশন ছিল আবেদনকারী, রাজ্য বিবাদী। নতুন লড়াইয়ে আবেদনকারী রাজ্য সরকার। এ বার রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে রাজ্য সরকারের কৌঁসুলির সওয়ালের জবাব দিতে হবে।
তবে হাইকোর্টের রায় যা-ই হোক না কেন, পুজোর আগে যে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ায় সমস্যা রয়েছে, রবিবার তা জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সুব্রতবাবুর যুক্তি: পশ্চিমবঙ্গে সাধারণত ৮ জুন বর্ষা নেমে যায়। বর্ষায় মানুষ চাষবাসে ব্যস্ত থাকেন, বহু জায়গা দুর্গম হয়ে পড়ে। বর্ষা চলে পুজো পর্যন্ত। এই পরিস্থিতিতে পুজোর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচন কী ভাবে হবে, সে প্রশ্ন তুলে পঞ্চায়েতমন্ত্রীর মন্তব্য, “আমরা দ্রুত পঞ্চায়েত নির্বাচন চাই এটা যেমন আদালতকে বলব, তেমনই জুন মাস পড়ে গেলে গেলে বর্ষাজনিত নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে, সেটাও কোর্টকে জানিয়ে রাখব।” |
অ্যাডভোকেট জেনারেলের বাড়িতে পঞ্চায়েতমন্ত্রী।—নিজস্ব চিত্র |
রাজ্য সরকার কী কী বিষয় তুলে ধরে সিঙ্গল বেঞ্চের রায়কে চ্যালেঞ্জ করবে, তা চূড়ান্ত করতে এ দিন বিকেলে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়ের ব্রড স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে বৈঠক করেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। বৈঠকে আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন। বৈঠকের পরে সুব্রতবাবু বলেন, “গত শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছে, তার উপর স্থগিতাদেশ নেওয়াটাই এখন মূল লক্ষ্য। পঞ্চায়েত ভোট কবে হবে, তা আমরা কী করে বলব! ভোট কবে হবে, এখন তা বলবে আদালত।” বৈঠকে স্থির হয়েছে, সোমবার প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এজলাসে বসার পরেই রাজ্যের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল বিচারপতি সমাদ্দারের রায়ে স্থগিতাদেশ চাইবেন।
কিন্তু কোন যুক্তিতে বিচারপতি সমাদ্দারের রায়ে স্থগিতাদেশ চাইবে রাজ্য? মহাকরণ-সূত্রের ব্যাখ্যা: রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ৪২ নম্বর ধারাকে অসাংবিধানিক হিসেবে অভিহিত করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছিল কমিশন। বিচারপতি সমাদ্দার তাঁর রায়ে ৪২ নম্বর ধারাটি বাতিল করেননি। কিন্তু ওই ধারায় রাজ্যকে নির্বাচনের দিন ঘোষণার যে অধিকার দেওয়া রয়েছে, রায়ে তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে আজ ডিভিশন বেঞ্চকে জানাতে চলেছে রাজ্য সরকার।
মহাকরণের সূত্রটি বলেন, ৪২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার ভোটের দিন ঠিক করবে। কিন্তু বিচারপতি সমাদ্দার কমিশনকে বলেছেন, ভোটের দিন স্থির করে সরকারকে জানাতে, যা অনুযায়ী সরকার ভোটের দিন ঘোষণা করবে। মহাকরণের সূত্রটির দাবি: রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ৪২ নম্বর ধারা খারিজ না-হলে এ হেন নির্দেশের কোনও ভিত্তি থাকতে পারে না। ডিভিশন বেঞ্চকে সওয়ালে এটাই বলবে রাজ্য। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে বিচারপতি সমাদ্দারের নির্দেশটিতেও কমিশনের প্রতি ‘পক্ষপাতিত্বের’ প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছে রাজ্য প্রশাসনের একাংশ। মহাকরণ-সূত্রের কথায়, “রাজ্য গোড়া থেকে বলছে, পঞ্চায়েত ভোট আয়োজনের জন্য রাজ্য পুলিশের পাশাপাশি অন্য রাজ্য থেকে সশস্ত্র পুলিশ আনা হবে। প্রশাসনের এই বক্তব্য কোন যুক্তিতে খারিজ করা হল, তা আদালতের কাছে জানতে চাওয়া হতে পারে।”
অন্য দিকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনও নতুন লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ডিভিশন বেঞ্চে কমিশনের বক্তব্য কী হবে, তা ঠিক করতে শনিবার রাতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে কমিশনের কৌঁসুলি সমরাদিত্য পালের বাড়িতে গিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এ দিন বিকেলে তাঁদের মধ্যে ফের এক দফা আলোচনা হয়েছে। কমিশনের সচিব তাপস রায়ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কমিশন-সূত্রের খবর: তারাও যে দ্রুত পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোর পক্ষপাতী, ডিভিশন বেঞ্চকে তা জানানো হবে। সবিস্তার জানানো হবে, কমিশন কী ভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কমিশন চায়, হাইকোর্ট এমন একটা ব্যবস্থা নিক, যাতে পঞ্চায়েত ভোট ঠিক সময়ে সেরে ফেলা যায়। এ জন্য অন্তর্বর্তিকালীন নির্দেশ চেয়েও প্রধান বিচারপতিকে কাছে আর্জি জানাতে পারে কমিশন। উপরন্তু রাজ্য বিচারপতি সমাদ্দারের নির্দেশ মেনে পর্যবেক্ষকদের তালিকা জমা দেয়নি। জমা দেয়নি কেন্দ্রীয় বাহিনীর হিসেবও। কমিশন এর প্রেক্ষিতে প্রয়োজনে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালত আবমাননার অভিযোগও আনতে পারে। যদিও এ প্রসঙ্গে পঞ্চায়েতমন্ত্রীর ব্যাখ্যা: “নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগে আমরা কী ভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে বাহিনী নিয়ে কথা বলব, তা বুঝতে পারছি না। তাই আমরা বলছি, হাইকোর্টের এই নির্দেশ অবাস্তব।”
বস্তুত ডিভিশন বেঞ্চ দ্রুত পঞ্চায়েত ভোট আয়োজনের নির্দেশ দিলেও কেন্দ্রীয় বাহিনী ও তিন দফায় ভোটের প্রশ্নে রাজ্য কোনও আপস করবে না বলেই মহাকরণ সূত্রের ইঙ্গিত। পাশাপাশি, দু’পক্ষই আভাস দিয়ে রেখেছে যে, বেঞ্চের রায় বিপক্ষে গেলে তারা সুপ্রিম কোর্টে যাবে।
এ হেন পরিস্থিতিতে জুনের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট কী ভাবে হবে, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। রাজ্য ধরেই নিয়েছে, পুজোর আগে পঞ্চায়েত ভোট অসম্ভব। জুনের মধ্যে ভোট না-হলে কী করা হবে, তা-ও ইতিমধ্যে ঠিক করে ফেলেছে রাজ্য। সুব্রতবাবু জানান, তেমন হলে তাঁরা আদালতের কাছে গিয়ে পঞ্চায়েতে প্রশাসক বসানোর আর্জি জানাবেন। আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পরে অর্ডিন্যান্স জারি করবে রাজ্য। তাতে বলা হবে, পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত প্রশাসকেরাই পঞ্চায়েত চালাবেন।
এ দিকে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন দিল্লিতে রাজ্যকে কটাক্ষ করে বলেন, তৃণমূল মানুষের সমর্থন হারিয়েছে, এবং তাই পঞ্চায়েত ভোট করতে চাইছে না। সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক উপলক্ষে দিল্লিতে সূর্যকান্ত বলেন, “পঞ্চায়েতমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করবেন। এ ভাবে চললে ফের সুপ্রিম কোর্টেও সরকার আবেদন জানাবে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূল এখন আদৌ গ্রাম-বাংলায় ভোট চাইছে না।” সূর্যবাবুর দাবি, “২০১১-র তুলনায় তৃণমূলের ভোট এখন কমেছে। তার উপরে এখন কংগ্রেস সঙ্গে নেই। এই অবস্থায় বামফ্রন্ট স্পষ্টতই অনেক এগিয়ে রয়েছে।” তাঁর কথায়, “সারদা-কাণ্ডের পরে গ্রামবাংলায় তৃণমূলের সমর্থন আরও কমেছে। সেই জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রাম বাংলার সমর্থন নিয়ে চিন্তিত।” যদিও তৃণমূলের হারানো ভোট সঙ্গে সঙ্গে সিপিএমের ঘরে চলে আসবে, এমন আশা করছেন না সূর্যকান্তবাবু। “সময়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন হলেও আমরা কোনও অবিশ্বাস্য ফল আশা করছিলাম না। রাতারাতি আমাদের সবাই ভোট দেবেন না। কিছু জেলা পরিষদে তৃণমূলের কাছে হারতাম। কিন্তু তাই বলে আমরা কখনওই চাইতাম না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধাক্কা খাক।” মন্তব্য বিরোধী দলনেতার।
|