চিন্নাস্বামীতে ম্যাচ শেষে দু’জন মাঠ ছেড়েছিলেন একে অন্যের থেকে মুখ ঘুরিয়ে। এক জনের শরীরী ভাষায় বিজয়ীর গর্বের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল ঔদ্ধত্য, অন্য জন বিজিত। তার পর রবিবারের রাঁচিতে এই প্রথম সাক্ষাৎ দুই আইপিএল অধিনায়কের বিরাট কোহলি এবং গৌতম গম্ভীর। আর দুই সাক্ষাতে মিল হাজার খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
টসের আগে দুই অধিনায়ককে দেখলে কে বলবে, কয়েক সপ্তাহ আগেই দু’জনের মধ্যে ও রকম ঝামেলা হয়ে গিয়েছে? হ্যান্ডশেক করার সময় কোহলি-গম্ভীর দু’জনের মুখে সৌজন্যের হাসি। ম্যাচ শেষের ছবির অমিলটা আরও বেশি। পেপসি আইপিএলের প্রথম দিকে বেঙ্গালুরুর সেই ম্যাচে যাঁর মাথায় উঠেছিল বিজয়ী অধিনায়কের মুকুট, সেই কোহলি আজ পরাস্ত। আর নাইট অধিনায়ক? কেকেআরের দ্বিতীয় হোম গ্রাউন্ডে জিতে প্লে-অফের স্বপ্নে নতুন অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজ পেলেন তিনি।
কিন্তু সেই অক্সিজেনের স্থায়িত্ব নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে কোথায়? রবিবারের দু’পয়েন্ট নিয়ে কেকেআর এখন ১৪ ম্যাচে ১২, হাতে পড়ে আর দুটো ম্যাচ। পুণে আর হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে দুইয়ে দুই করতে পারলে গ্রুপ পর্ব শেষ হবে মোট ১৬ পয়েন্ট নিয়ে। তাতে প্লে-অফের দরজা খুলবে কি? এ দিন ম্যাচের সেরা জাক কালিস যতই বলুন, “এখনও আমরা প্লে-অফে যেতে পারি,” সেই অঙ্কে জিতেও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ভিড় করে আসছে একরাশ শর্ত। বাকি দুটো ম্যাচ নাইটদের জিতলেই শুধু চলবে না। আরসিবি আর সানরাইজার্স চতুর্থ হওয়ার দৌড়ে নাইটদের লড়াই মূলত যাদের সঙ্গে তাদের নিজেদের বাকি দুটো ম্যাচ হারতেই হবে। আরসিবি-র পরের ম্যাচ সামনের মঙ্গলবার, ঘরের মাঠ চিন্নাস্বামীতে কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচ আরসিবি হারবে, এমন অবাস্তব সম্ভাবনার উপর অতি বড় নাইট-ভক্তও বাজি ধরার আগে দশ বার ভাববেন। রবিবার তাই জিতলেও এই মুহূর্তে কেকেআর যে নড়বড়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তাতে বুধবার পুণে ওয়ারিয়র্স ম্যাচের আগেই প্লে-অফের যাবতীয় স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে!
|
ম্যাচ জেতানো জুটি। ছবি: বিসিসিআই |
আর সে জন্যই আরসিবি-র মতো হেভিওয়েট প্রতিপক্ষকে হারিয়েও উৎসবের আনন্দে গা ভাসানো নেই নাইট শিবিরে। আইপিএলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনও দিন আরসিবি ম্যাচ জিতে এ রকম অস্বস্তি নিয়ে ঘুরতে হয়নি গম্ভীরদের। রাঁচির দর্শকও ম্যাচ থেকে বিরাট কিছু পেলেন কি? উত্তরটা না, কারণ কেকেআরের ডিজাইনার পিচ যে এ ভাবে একটা কুড়ি ওভারের ম্যাচ থেকে টি-টোয়েন্টির যাবতীয় আতসবাজি কেড়ে নেবে, জানা ছিল না।
অথচ উৎসবের আবহে কোনও খামতি ছিল না। বরং প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি গরমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুপুর দেড়টা থেকেই স্টেডিয়ামের বাইরে লাইন দেওয়া ছিল। “আশা করি দুটো টিমই আমার শহরের মানুষকে বিনোদন উপহার দেবে,” বলে ঘরের ছেলে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির টুইট করা ছিল। মাঠের বাইরে সোনালি-বেগুনি ফ্ল্যাগের সঙ্গে আরসিবি-র জার্সি বিক্রি ছিল।
আগুনরঙা জার্সিগুলো গুটিয়ে ফেলা শুরু হল আধঘণ্টা যেতে না যেতে! কী করা যাবে, ক্রিস গেইল-ই তো ‘চোক’ করে গেলেন! ক্যারিবিয়ান ‘পাইরেট’-এর স্ট্রাইকরেট কি না একশোর নীচে! করছেন ৩৬ বলে ৩৩! রাঁচির উইকেটে আটকে গিয়ে গেইল এতটাই হতাশ হয়ে পড়লেন যে, আউট হওয়ার পরপরই টুইটারে তাঁর দুঃখমিশ্রিত রসিকতা ভেসে উঠতে দেখা গেল ‘লোকে বলে আমি যে কারও মতো ব্যাট করতে পারি। তাই আজ পমার্সব্যাচের মতো ব্যাট করলাম।’ যা দেখে লুক পমার্সব্যাচের পাল্টা টুইট: “আমার মতো ব্যাট করলে অন্তত পুরো ইনিংসটা ক্রিজে থেকে আসলে পারতে।” আর শুধু গেইল কেন, দিল্লির বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ কোহলিকেও দেখতে হল, তাঁর টিম পাওয়ার প্লে-তে তুলছে ২২ রান! আজ পর্যন্ত আইপিএলের ইতিহাসে আরসিবি-র যা সর্বনিম্ন। পিচ রিডিংয়ে এ দিন গম্ভীর টেক্কা দিলেন কোহলিকে। গম্ভীর যেখানে বাড়তি স্পিনার খেলালেন, সেখানে স্পিনার বসিয়ে কোহলি খেলালেন এক জন বাড়তি পেসারঅভিমন্যু মিঠুন। লাভের লাভ? চার ওভারে ৩৭ খরচ, উপরি কালিসের ক্যাচ ফস্কানো। |
আশার হিসেব |
• গম্ভীরদের (১৪ ম্যাচে ১২) লিগের শেষ দুই ম্যাচে জিততে হবে এবং বড় ব্যবধানে জিততে হবে।
• পরের ম্যাচ পুণের বিরুদ্ধে। তার পর কেকেআরের যুদ্ধ হায়দরাবাদে সানরাইজার্সের বিরুদ্ধে। দুই ম্যাচে জিতলে ১৬ পয়েন্ট নিয়ে লিগ শেষ করবেন গম্ভীররা।
• চতুর্থ স্থানের জন্য এখন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ও হায়দরাবাদ সানরাইজার্সের সঙ্গে কেকেআরেরও লড়াই। বেঙ্গালুরুর ১৪ ম্যাচে ১৬ ও হায়দরাবাদের পয়েন্ট ১৩ ম্যাচে ১৬।
• এই দুই দল যদি তাদের শেষ ম্যাচগুলিতে হেরে যায়, তা হলে তারাও ১৬-তেই থেকে যাবে। সেক্ষেত্রে নেট রান রেটে এগিয়ে থাকলে কলকাতা শেষ চারে পৌঁছে যেতে পারবে।
• বেঙ্গালুরুর ম্যাচ বাকি কিংস ইলেভেন পঞ্জাব (মঙ্গলবার) ও চেন্নাই সুপার কিংসের (শনিবার) বিরুদ্ধে।
• হায়দরাবাদের ম্যাচ বাকি মুম্বই (সোমবার), রাজস্থান (শুক্রবার) ও কলকাতার (রবিবার) বিরুদ্ধে। |
|
যার ফায়দা ঠিকঠাক তুলতে পারলেও রাঁচি দর্শকের গোমড়াথেরিয়াম হয়ে ফেরার কথা নয়। গেইল না হোক, গম্ভীর ছিলেন। এবি ডে’ভিলিয়ার্সের বদলে পাঠানের ঠ্যাঙানিও বা মন্দ কী? কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি, উল্টে কেকেআর ব্যাটিংয়ে আরসিবি ইনিংসের অ্যাকশন রিপ্লে! ১১৬ তুলতে নাইটদের লেগে গেল প্রায় কুড়ি ওভারই। এবং আবার ব্যাটিং ব্যর্থতার সেই পুরনো, খুব চেনা ছবি। গম্ভীর তাড়াতাড়ি আউট, ইউসুফ পাঠান সেই ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার উইদাউট ইমপ্যাক্ট’, মনোজ সেই ম্যাচ ফিনিশ করে আসতে ব্যর্থ। ১৫ বলে যখন চাই ১৩, মেরে খেলার কথা যখন গলি ক্রিকেটেও কেউ ভাববে না, তখন তুলে মারতে গিয়ে কভারে আরসিবি ক্যাপ্টেনের হাতে জমা পড়লেন মনোজ। মুম্বই ম্যাচে বাদ পড়ে বিদ্রোহী টুইট করতে পারেন, কিন্তু সুযোগ পেলে একটাও ম্যাচ ফিনিশ করে আসতে পারেন না।
ভাগ্যিস, পিচ সহায় ছিল। নইলে বেফাঁস কিছু ঘটে গেলে আজ ক্ষমা পেতেন তো মনোজ?
|