রবি-বিকেলে রক্ত লাল ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকদের হাতে-হাতে প্রিয় ক্লাবের লাল পতাকা উড়ছে। মানব-বন্ধনে কোনও স্ট্যান্ডে ফুটে উঠছে ‘চ্যাম্পিয়ন্স’ লেখাটা। কোনও গ্যালারি জুড়ে ‘ফার্গি রুলস’। কালো বাজারে ম্যাচটার টিকিটের দাম উঠেছিল ভারতীয় মুদ্রায় মোটে আড়াই লক্ষ টাকা! তবু ৭০ হাজারের গ্যালারি ম্যাচ শুরুর তিন ঘণ্টা আগেই সম্পূর্ণ ভর্তি। অথচ টুর্নামেন্টের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাচটার কোনও গুরুত্ব নেই। রবিবারের আগেই যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ খেতাব জিতে গিয়েছে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড।
ভুল। রেড ডেভিল-রা তো শুধু ইপিএল জয়ীই ছিল। ‘চ্যাম্পিয়ন’ তো হল রবিবারই। জয়ী আর চ্যাম্পিয়ন দুটো ভিন্ন প্রজাতি। আর সেটাই ঘরের মাঠে তাঁর বিদায়ী ম্যাচে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন একটানা ২৭ বছরের ম্যান ইউ বস স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন।
|
শেষ বার ট্রফি নিয়ে। ছবি: এএফপি |
আগেই ম্যান ইউ হোম গ্রাউন্ডে স্যর ফার্গির নামে স্ট্যান্ড আর তাঁর মূর্তি ছিল। এ দিন শুধু তাঁর নিজের দলের ফুটবলাররাই নন, প্রতিপক্ষ সোয়ানসি প্লেয়াররাও ম্যাচের আগে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ফার্গুসনকে বিরল ‘গার্ড অব অনার’ দিলেন। ৭১ বছরের চিরযুবক কোচ তখন তাঁর ট্রেডমার্ক চুইংগাম চিবনোর মধ্যেও যেন সামান্য বিব্রত। ঐতিহ্যশালী ম্যান ইউয়ের ঐতিহাসিক ওল্ড ট্র্যাফোর্ড স্টেডিয়ামের সাউন্ড সিস্টেমে তখন বাজছে ‘দ্য ইমপসিবল ড্রিম’। যে গানকে যেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে গ্যালারির সবচেয়ে বড় ব্যানারটা ‘স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন, দ্য ইমপসিবল ড্রিম মেড পসিবল।’
সত্যিই। ম্যান ইউয়ের ২০তম ইংলিশ লিগ খেতাবের মধ্যে ‘ইপিএল’ সৃষ্টির পর এটা ১৩তম খেতাব। তেরোটাই ফার্গুসন-যুগে। ২৭ বছরে ক্লাবকে ৩৮টা ট্রফি দেওয়া কোচ অবসর নেওয়ায় টিমের অন্যতম এক ফুটবলার একই দিনে অবসর নিচ্ছেন এমন ঘটনা আগে শোনা গিয়েছে কি? ফার্গুসনের যদি এটা ম্যান ইউ ম্যানেজার হিসেবে ১৪৯৯ নম্বর ম্যাচ (শেষ করবেন দেড় হাজারে, ওয়েস্ট ব্রমউইচের বিরুদ্ধে ১৯ মে অ্যাওয়ে ম্যাচে) হয়, তা হলে আটত্রিশ বছরের পল স্কোলস এ দিন ম্যান ইউয়ের চিরাচরিত লাল জার্সিতে ৭১৭ নম্বর ম্যাচ খেলে বিদায় নিলেন। স্যর ফার্গির হটসিটে যিনি, সেই এভার্টন কোচ ডেভিড মোয়েসেরও এ দিন ঘরের মাঠে বিদায়ী ম্যাচ ছিল। কিন্তু গুডিসন পার্কের গ্যালারি জুড়ে ‘স্ট্যান্ড আপ ফর দ্য চ্যাম্পিয়ন্স’ লেখা কোনও ব্যানার দেখা যায়নি। |
চ্যাম্পিয়নসুলভ মেজাজেই কোনও সমালোচনার তোয়াক্কা না করে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে শেষ ম্যাচেও ফার্গুসন নিজস্ব ভঙ্গিতে দল গড়লেন। স্কোয়াডেই রাখেননি ওয়েন রুনিকে। রিজার্ভ বেঞ্চেও ঠাঁই হচ্ছে না হয়তো আঁচ করেই ম্যাচের আগে রুনি টুইট করেন, “ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ম্যাচের দিকে তাকিয়ে আছি। উত্তেজিত লাগছে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কাপটা তুলতে পারব আর নিজের পাঁচ নম্বর ইপিএল চ্যাম্পিয়ন মেডেলটা গলায় ঝোলাব ভেবে।’ টুইটের কোত্থাও স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন নামটাই নেই।
তাতেই বা কী? ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলার গ্যারি নেভিল থেকে শুরু করে বর্তমান অধিনায়ক ভিডিচের টুইট আছড়ে পড়ছিল ম্যাচের আগে-পরেও। ‘স্যর ফার্গি সব মরসুম শেষেই ম্যান ইউ সমর্থকদের উদ্দেশ্যে মাঠে ভাষণ দেন। কিন্তু আজ কী বলেন শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।’ কিংবা, ‘আজ ট্রফিটা আমাদের ফুটবলারদের হাতে নেওয়ার দিন নয়। আমরাই চেয়েছিলাম ফার্গুসন দলের হয়ে ট্রফিটা গ্রহণ করুন পুরস্কার মঞ্চে। আজকের দিনটা ম্যান ইউয়ের চেয়েও অনেক বেশি তার ম্যানেজারের।’ |
আপ্লুত। আবেগী। বিব্রত। উদ্বেলিত ফার্গুসন কী বললেন? “রুনিকে আজ খেলাইনি কারণ ও পুরো আগ্রহী ছিল না। আমাকে বলেছে, ও ক্লাব ছাড়বে। কিন্তু আমি আর্জি বাতিল করে দিয়েছি। নতুন ম্যানেজার সিদ্ধান্ত নেবে। আর গত ক্রিসমাসে আমার স্ত্রীর বোনের মৃত্যুর পর এই অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার সন্তানদের জানিয়েছি গত মার্চে।”
এমন আবেগঘন মুহূর্তে কে আর ম্যান ইউ-সোয়ানসি ম্যাচের স্কোরলাইন মনে রাখে? লিখতে হয় বলে লেখা। চিচারিতো আর ফার্দিনান্দদু’অর্ধে দু’জনের গোলে ২-১ জিতল ম্যান ইউ। দল হারুক বা জিতুক, রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে-সঙ্গে ডাগআউট থেকে উঠে সটান ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটা লাগানোই দস্তুর ফার্গুসনের। এ দিন মাঠে ঢুকে এলেন। তার পর একে-একে নিজের প্রত্যেক ছেলেকে জড়িয়ে ধরা। সেই সময় স্যর ফার্গির চোখের কোণ চিকচিক করছিল কি? তবে আকাশ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নামল ঠিক তখনই। ফুটবলদেবতাও হয়তো চোখের জল সামলাতে পারলেন না! নাকি ওটা ফার্গুসনকে ফুটবলদেবতার আশীর্বাদ? গ্যালারিতে ততক্ষণে উড়ছে বিশাল ব্যানার ‘থ্যাঙ্ক ইউ, স্যর!’
|