স্বাগত জানিয়েও নওয়াজ নিয়ে ধন্দ ভারতের
লাহৌরের মডেল টাউন। এই গলিটায় পরপর প্রায় দশটি বাড়ি নওয়াজ শরিফ এবং তাঁর ভাইদের। ১৯৯০ সালে বেনজির ভুট্টোকে হারিয়ে ইসলামাবাদে ক্ষমতায় এলেন নওয়াজ। সে বার পাক নির্বাচন কভার করতে যাওয়া এই প্রতিবেদককে মডেল টাউনে নিজের বাসভবনে বসে তিনি বলেছিলেন, “আমি নিজে একজন ব্যবসায়ী। ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যটা ভাল হওয়া যে এ দেশের আমজনতার জন্য কতটা দরকার, সেটা বুঝতে আমার কোনও ভুল হয় না। যুদ্ধ নয়, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চাই।” আজ এত বছর পর পাকিস্তানের সেই পঞ্জাবী নেতা আবার ইসলামাবাদে ক্ষমতাসীন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আবার একটা অসামরিক সরকার গড়তে চলেছেন তিনি।
প্রশ্ন হল, নওয়াজের এই পুনরাভিষেককে ভারত কী ভাবে দেখছে?
বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন নওয়াজের ফের ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে সকলেই উচ্ছ্বসিত। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ভোটের ফল পুরো প্রকাশিত হওয়ার আগেই নওয়াজকে অভিনন্দন তো জানিয়েইছেন, সেই সঙ্গে তাঁকে ‘সুবিধামতো সময়ে’ ভারতে আসার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। নওয়াজের এই জয়কে স্বাগত জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও। সকলেরই বক্তব্য, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি সরকার পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলে সেটি ভারতের কাছে সব সময়ই খুশির খবর। সেনাবাহিনী, আইএসআই অথবা মোল্লাতন্ত্র তখনই বেশি বেশি করে পাক সরকারকে পুতুল নাচ নাচায়, যখন নির্বাচিত সরকারটি দুর্বল হয়। এ বারে তা হয়নি। শুধু তাই নয়, শপথ নেওয়ার আগেই নওয়াজ শরিফ ভারতীয় চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি ২৬/১১-র ঘটনায় আইএসআইয়ের ভূমিকার তদন্ত করবেন। কার্গিল তদন্তের সমস্ত তথ্য ভারতকে দেখাবেন। পাকিস্তানের জমিতে সন্ত্রাস হতে দেবেন না। এমনকী হাফিজ সইদকেও নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং যৌথ ভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করবেন।

২০০৯-এ লাহৌর ঘোষণার সময় অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে।
সব মিলিয়ে সেই পুরনো ইতিবাচক সুর নওয়াজের গলায়। যা ভারতের কাছে যথেষ্ট আশার। আসলে ভারত সরকার বেশ কিছু দিন ধরেই বুঝতে পারছিল যে, নওয়াজের ফের ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা প্রবল। ভৌগোলিক ভাবে পাকিস্তানের যে চারটি ভাগ, তার মধ্যে সব থেকে বড় অংশটি পঞ্জাব। পাক সংসদের সব থেকে বেশি আসন এখানেই। ফলে পাক ভোটে পঞ্জাব লবিই সব থেকে বেশি শক্তিশালী। আর নওয়াজ সেখানকার প্রতিনিধি শুধু নন, সেখানে তাঁর প্রভাবও প্রচুর। ভারত বরাবরই সেই অঙ্ক মাথায় রাখে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন বিদেশমন্ত্রী। ইসলামাবাদে জারদারি-গিলানি জমানা চললেও প্যারিস সফরে গিয়ে প্রণববাবু এক রকম নিঃশব্দেই নওয়াজ শরিফের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করেছিলেন। আসলে নওয়াজের সঙ্গে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটা ট্র্যাক-টু কূটনীতি সব সময়ই চালু রাখা হয়েছিল। গত নির্বাচনের আগে যে দিন দুবাই থেকে নির্বাসন কাটিয়ে নওয়াজ দেশে ফেরেন, সে দিন যে ভাবে পাক জনতা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, সেটা দেখেই ভারত নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, পাকিস্তানের আগামী দিনের দেওয়াল লিখন নওয়াজ শরিফই।
প্রশ্ন হচ্ছে, বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের প্রবল সংঘাতের আবহে পিপিপিকে হারিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়া নওয়াজ শরিফ, ১৯৯৯ সালে লাহৌর বাস কূটনীতির নওয়াজ শরিফ আর আজকের নওয়াজ শরিফ কি একই ব্যক্তি? আগের মতোই কি ইতিবাচক, সাহসী হবেন তিনি?
কূটনৈতিক মহলে একটা পাল্টা তত্ত্ব আছে। সেটি হল, নওয়াজ শরিফের গুরু ছিলেন জিয়াউল হক। ভারত-পাক ছায়াযুদ্ধের জনক যে পাক প্রেসিডেন্ট ভারতকে হাজার টুকরোয় ভাগ করার তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এ হেন জিয়ার ভাবশিষ্য নওয়াজ যখন লাহৌর বাসযাত্রা করেন, তখন তিনি স্বাভাবিক ভাবেই চটিয়ে ফেলেন দেশের সেনা, আইএসআই, মোল্লাতন্ত্রকে। নওয়াজের ‘ভারত প্রেমের’ পাল্টা হিসেবে যারা সে দিন সমবেত ভাবে সমর্থন করেছিল সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফকে। সে দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিশ্চয়ই ভোলেননি নওয়াজ। সুতরাং, মুখে যা-ই বলুন, এ বারে তিনি যে আগের থেকে অনেক বেশি সাবধানী হবেন, সে বিষয়ে এক রকম নিশ্চিত নয়াদিল্লি।
সবচেয়ে বড় কথা, নওয়াজকে সতর্ক থাকতে হবে দেশের সেনাবাহিনীকে নিয়ে। তাঁর একাধিপত্যে থাবা বসাতেই এ বারের ভোটে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফের দিকে। কূটনৈতিক মহলের বক্তব্য, সেনাবাহিনীর অঙ্ক ছিল, পাক জনতার একটা বড় অংশের নয়নের মণি ইমরান পঞ্জাব থেকে ভাল সংখ্যক আসন পেলে নওয়াজের ক্ষমতা অনেকটাই কমবে। সে ক্ষেত্রে নওয়াজ-ইমরান জোট সরকারের অঙ্কও ছিল। তেমনটা হলে নবনির্বাচিত পাক সরকারের উপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হল না।
কিন্তু তা-ই বলে সেনাবাহিনী বসে থাকবে, এমনটাও ভাবছেন না কেউই। আসলে কার্গিল এবং পারভেজ মুশারফের ষড়যন্ত্রের পুরনো স্মৃতিই তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অঙ্কটা। যেখানে ভারত-বিরোধিতার সুর নরম করলেই সমস্যা বাড়ে। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রথম বিদেশ সফর ছিল কলম্বোয় সার্ক সম্মেলন। সেই সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী ছিলেন এই প্রতিবেদক। কলম্বোয় তাজ সমুদ্র হোটেলে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বাজপেয়ীর বৈঠক হয়। সে দিন বৈঠকের মধ্যেই নওয়াজ বলেছিলেন, “আমি বন্ধুত্ব চাই।” কিন্তু বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেছিলেন, বাজপেয়ীর সঙ্গে তাঁর বৈঠকের নিট ফল শূন্য! বাজপেয়ীর সরকারকে একান্তে তিনি এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভারত বিরোধিতার তাস তাঁকে খেলতেই হবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য।

ভারতে নওয়াজের পৈতৃক গ্রামের মানুষও সামিল জয়ের উৎসবে। ছবি: এএফপি
কিন্তু সেই বছরই নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনে যোগ দিতে এসে আবার দু’জনের বৈঠক হয়। তখন প্রবল মার্কিন চাপের মুখে পড়ে নওয়াজ আমেরিকায় যৌথ সাংবাদিক বৈঠক করে লাহৌর বাসযাত্রার কূটনীতির কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। সে দিন তিনি বুঝতে পারেননি, সম্ভবত ওই মুহূর্ত থেকেই ভারত-পাক শান্তি প্রক্রিয়া ভেস্তে দিতে পাল্টা তৎপরতা শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের অন্দরে।
তার ইঙ্গিতও মিলছিল। কিন্তু সে সময় পাত্তাই দেয়নি কেউ। বাসযাত্রার সময় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী যখন লাহৌরে যান, পাক সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ-সহ তিন জন সার্ভিস চিফ তাঁকে বয়কট করেছিলেন। হেলিপ্যাডে আসেননি কেউই। আর বাজপেয়ী যখন লাহৌর ফোর্টে গিয়েছিলেন, তখন মৌলবাদী কিছু গোষ্ঠী তাঁকে কালো পতাকা দেখিয়েছিলেন। সে দিন যে হেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁর পক্ষে ছিল, তাই নওয়াজ ওই বিষয়গুলিকে অবজ্ঞা করেছিলেন। বোঝেননি, ওই সব বিক্ষোভের পিছনে যারা ছিল, তাদের ক্ষমতা কত! বুঝেছিলেন পরে, গদি হারিয়ে। এ বারেও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। তবু সেনা-আইএসআই বা মোল্লাতন্ত্রকে আগের মতো অবজ্ঞা করার বিলাসিতা সম্ভবত নওয়াজ এ বারে দেখাবেন না। তাই এ যাত্রায় নওয়াজ কতটা ‘লিপ সার্ভিস’ দেবেন আর কতটা সত্যি সত্যিই ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন, সেটা দেখার। দেশের সাধারণ নির্বাচনের অঙ্কেই ভারতকে ‘মোস্ট ফেভার্ড নেশনের’ মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি আটকে রেখেছিল পাকিস্তান। ভারত মনে করছে, নওয়াজের সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় এটি বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে। আর তা হলেই দু’দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের দরজা খুলে যাবে। দুই কাশ্মীরের মধ্যে ব্যবসায়িক আদানপ্রদানও বাড়বে। মনমোহন সিংহ অনেক দিন থেকেই পাকিস্তান যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। আবার মনমোহনের আমন্ত্রণ পৌঁছনোর আগেই নওয়াজ নিজের মনোভাব বোঝাতে আজ আগেভাগে ঘোষণা করেছিলেন, দিল্লি আমন্ত্রণ না জানালেও তিনি ভারত সফর করবেন।
সব মিলিয়ে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। ইতিবাচক। অন্তত এখনও। নওয়াজ শরিফ আবার ক্ষমতায় ফেরায় নিঃসন্দেহে ভারত খুশি। তবু দেশটার নাম পাকিস্তান। তাই ইতিহাসের কথা মাথায় রেখে ভারত এ ব্যাপারে ঘরপোড়া গরু। তাই সতর্ক নওয়াজ শরিফ। সতর্ক ভারতও।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.