চোদ্দো বছর আগেকার এক সেনা অভ্যুত্থান তাঁকে গদি থেকে টেনে নামিয়েছিল। জেলে যেতে হয়েছিল, দেশছাড়া হয়ে থাকতে হয়েছিল দীর্ঘদিন। ২০১৩-র ভোটে যেন পুরনো দিনের সুদে-আসলে হিসেব নিলেন নওয়াজ শরিফ। পাক প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর প্রত্যাবর্তন এখন সময়ের অপেক্ষা।
সরকারি ভাবে ফল ঘোষণার আগেই নওয়াজকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। নওয়াজও বলছেন, “ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিকেই আমি সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।”
গত রাতে ভোটের লিখন স্পষ্ট হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই নওয়াজের লাহৌরের বাড়ির সামনে জমতে শুরু করেছিল সমর্থকদের ভিড়। নওয়াজ তাঁদের বলেছিলেন, “প্রার্থনা করুন যাতে আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাই।” সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, মোট ২৭২টি আসনের মধ্যে ১১৮টিতে জিতেছে নওয়াজের দল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তত ১২৫টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার (১৩৭) প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যাবে পিএমএল(এন)। সে ক্ষেত্রে জমিয়ত উলেমা-এ-ইসলামের মতো ছোট দল এবং কিছু নির্দল প্রার্থীর সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ার দাবি জানাবেন নওয়াজ। ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিপিপি-র মতো বিরোধী দলগুলির মুখাপেক্ষী হয়ে যে তাঁকে থাকতে হবে না, সেটাই তাঁর সব চেয়ে বড় স্বস্তি।
|
সমর্থকদের সামনে তৃপ্ত শরিফ। ছবি: এএফপি |
বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস মিলিয়ে দিয়েই এ বারের ভোটে শাসক পিপিপি-র ভরাডুবি হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরফ-সহ তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য হেরে গিয়েছেন। হেরেছেন ইউসুফ রাজা গিলানির দুই ছেলেও। এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩২টি আসন পেয়েছে পিপিপি। পরিবর্তনের সুনামির ডাক দেওয়া ইমরানের দলও পেয়েছে ৩২টি আসন। পরাজয় স্বীকার করে নিয়েও ইমরান বলেছেন, “নবীনদের উৎসাহ দেখে আমি সব দুঃখ ভুলে গিয়েছি। ভোটদাতাদের ধন্যবাদ, তাঁরা বিপুল সংখ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে ভোট দিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চান।” তবে খাইবার পাখতুনখওয়ায় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফ একক বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসছে। ২০০৮ নির্বাচনে বিপর্যয়ের নিরিখে সেটা অবশ্যই তাঁর কাছে সান্ত্বনা পুরস্কার। অন্য দিকে, পিপিপি তাদের শক্ত ঘাঁটি সিন্ধু প্রদেশে আইনসভার ভোটে এগিয়ে। মহাগুরুত্বপূর্ণ পঞ্জাব প্রদেশে অবশ্য শরিফদেরই জয়জয়কার। নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফের ফের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার রাস্তা পরিষ্কার।
স্বভাবতই সারা দিনে বারবার আবেগে ভেসেছেন নওয়াজ। দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, “আপনাদের বিশ্বস্ততা দেখে আপনাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। আপনাদের সেবা করার আরও একটা সুযোগ আমি পাচ্ছি।” আরও বলেছেন, “১৯৯৯ সালে যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকেই আবার কাজ শুরু করতে চাই।” ভোটের অঙ্ক স্বস্তি দিলেও প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় ইনিংসে চ্যালেঞ্জের পাহাড় অপেক্ষা করছে নওয়াজের সামনে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মোল্লাতন্ত্রের রমরমা। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, টানা লোডশেডিংয়ের মতো নানা সমস্যায় আমজনতা অতিষ্ঠ।
এ বারের ভোটে তাই নওয়াজের স্লোগান ছিল, ‘শক্তিশালী অর্থনীতি শক্তিশালী পাকিস্তান।’ বিশেষজ্ঞদের আশা, খোলা বাজারের অর্থনীতির সমর্থক নওয়াজ বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ করতে পারেন। ঢালাও বেসরকারিকরণের পথে হাঁটতে পারেন তিনি। ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টাও করতে পারেন। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের কাছে নওয়াজ নতুন প্যাকেজের আবেদন জানাতে পারেন বলেও মনে করা হচ্ছে।
নতুন নওয়াজ-জমানায় পাক-মার্কিন সম্পর্ক নিয়েও কৌতূহলী বিশেষজ্ঞরা। আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের আগে দু’দেশের মধ্যে যথেষ্ট টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অবশ্য বলেছেন, “আমরা আশাবাদী, নতুন পাক সরকারের সঙ্গে জোট বেঁধে সে দেশের জনতার ভবিষ্যৎ গড়তে পারব।” কিন্তু আমেরিকার লড়াইয়ে মদতের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে প্রচারপর্বে মন্তব্য করেছিলেন নওয়াজ নিজেই। |
শরিফ যাত্রা |
পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী
• ১৯৮৫-১৯৯০ |
প্রধানমন্ত্রী
• প্রথম দফা ১৯৯০-১৯৯৩
• দ্বিতীয় দফা ১৯৯৭-১৯৯৯ |
প্রধানমন্ত্রিত্বে
• ২৮ ও ৩০ মে, ’৯৮, পরমাণু বোমা পরীক্ষা
• ফেব্রুয়ারি, ’৯৯, অটলবিহারী বাজপেয়ীর
লাহৌর বাসযাত্রা, লাহৌর ঘোষণা
• মে-জুলাই, ’৯৯, কার্গিল যুদ্ধ |
১২ অক্টোবর, ১৯৯৯, সামরিক অভ্যুত্থান
• যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
• সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় ১০ বছর নির্বাসন |
দেশে ফেরা
• ১০ নভেম্বর ২০০৭ লন্ডন থেকে ফেরা
মাত্রই পাঠানো হল সৌদি আরবে
• পাকাপাকি ফিরলেন ২৫ নভেম্বর ২০০৭ |
ফের ক্ষমতায়
• ১২ মে ২০১৩ |
|
বস্তুত, তালিবানি সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে নওয়াজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। কারণ, তিনি সেনা অভিযানের বদলে তালিবানের সঙ্গে আলোচনারই পক্ষপাতী (তালিবানও তাই নওয়াজের দলকে ভোটের প্রচার চালানোর ছাড়পত্র দিয়েছিল)। কিন্তু সেনাপ্রধান আশফাক কিয়ানি সাফ জানান, তিনি জঙ্গিদের রেয়াত করবেন না। পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সেনাই কার্যত শেষ কথা বলে। কাজেই কিয়ানির বাহিনীর সঙ্গে নওয়াজ কী ভাবে বোঝাপড়া করেন, সেটাই দেখার।
তবে বিশেষজ্ঞরা অনেকে মনে করছেন, নব্বইয়ের দশকের নওয়াজ শরিফের সঙ্গে এই নওয়াজ শরিফের অনেক পার্থক্য। এই নওয়াজের বাস্তববোধ অনেক বেশি। নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার পর যথেষ্ট পরিশ্রম করে দলের ভিত্তি মজবুত করেছেন তিনি। পিপিপি-র সরকার দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন, যাতে গণতান্ত্রিক কাঠামো মজবুত হয়। আজও বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্তৃত্ব ফের প্রতিষ্ঠা করাই এখন আমাদের প্রধান কাজ।” কিন্তু সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করাও যে সম্ভব নয়, এক বার ক্ষমতা খোয়ানো নওয়াজ শরিফ তা জানেন। পাকিস্তানের উন্নতির স্বার্থে ইতিমধ্যেই সব দলকে পাশে চেয়েছেন তিনি। এই ভারসাম্যের ভার নিয়েই দেশের হাল ফেরানোর পরীক্ষায় বসতে চলেছেন মিয়াঁ মহম্মদ নওয়াজ শরিফ।
|