জঙ্গলমহলের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর হাল ফেরাতে পাঠানো হয়েছিল অ্যাম্বুল্যান্স। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই চালু হয়নি। চালকেরা বসে বসে মাইনে পাচ্ছেন। এমনকী, বেশ কিছু জায়গায় স্থানীয় ক্লাবগুলি ওই গাড়ি নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ। জঙ্গলমহলের অন্তর্গত একাধিক জেলা থেকে এই ঘটনা সামনে আসায় অস্বস্তিতে স্বাস্থ্য দফতর।
রাজ্যে পালাবদলের পরই সাংসদ তহবিলের টাকায় ৬টি অত্যাধুনিক ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্স কিনে স্বাস্থ্য দফতরের হাতে তুলে দিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। ২০১১-র জুলাই মাসে কলকাতার এক পার্কে অনুষ্ঠান করে অ্যাম্বুল্যান্সগুলি স্বাস্থ্যকর্তাদের দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। ৬টি অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে ৫টি পাঠানো হয় পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম, ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, গোপীবল্লভপুর, শালবনিতে। একটি যায় পুরুলিয়ার বলরামপুরে। অভিযোগ, ঝাড়গ্রামের অ্যাম্বুল্যান্সটিই শুধু রোগীদের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। বাকিগুলি কাজে লাগছে না। কেন ব্যবহার করা হচ্ছে না এই সব অ্যাম্বুল্যান্স? জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গোড়ায় সমস্যা ছিল চালকের। কিছু দিন আগে পশ্চিম মেদিনীপুর সফরে এসে চালকের অভাবে অ্যাম্বুল্যান্সগুলো পড়ে থাকার খবর শুনে চটে যান মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে চালকের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু তাও অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহার শুরু হয়নি। |
স্বাস্থ্য ভবনের কর্তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তাঁরা বলেন, ওই অত্যাধুনিক অ্যাম্বুল্যান্সে রোগীদের নিয়ে যেতে হলে সঙ্গে ডাক্তার এবং টেকনিশিয়ান চাই। ব্লকে হয়তো ডাক্তার মিলতে পারে, তবে টেকনিশিয়ান সহজে মেলে না। ফলে, রোগীদের যাতায়াতের জন্য সব সময় এই অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে পড়ে থাকা অ্যাম্বুল্যান্স এখনও স্বাস্থ্য দফতরের অন্তর্গত পরিবহণ বিভাগে নথিভুক্ত পর্যন্ত করা হয়নি।
এই অবস্থায় অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহার না-করে চালকদের বসিয়ে ১০-১২ হাজার টাকা করে মাইনে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যেমন, পুরুলিয়ার বাঁশগড় গ্রামীণ হাসপাতালে গত প্রায় ২১ মাস ধরে পড়ে রয়েছে ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্সটি। এর জন্য ১০ হাজার টাকা বেতনের ড্রাইভারও নিয়োগ হয়েছে। তা-ও অ্যাম্বুল্যান্স চলে না। জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, “এই গাড়িটা খুব আধুনিক। কী ভাবে ব্যবহার করব তা জানতে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে বার বার গাইডলাইন চেয়ে পাঠিয়েছি। জবাব আসেনি। তাই এগোইনি।”
স্বাস্থ্য দফতরের মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে, জঙ্গলমহলে পরিকাঠামোর অভাবে যেখানে প্রত্যন্ত গ্রামের রোগীরা সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছতে পারেন না, আসন্ন-প্রসবা হাসপাতালে যাওয়ার গাড়ি পান না, সেখানে এত লক্ষ টাকার অ্যাম্বুল্যান্স ফেলে নষ্ট করা হয় কী ভাবে? কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “সে সব আমাদের খোঁজ নেওয়ার কথা নয়। আমরা দিয়ে দিয়েছি, এটুকুই। স্বাস্থ্য দফতর বুঝবে সেটা ব্যবহার করবে না করবে না।” আর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “কবে পুরসভা জঙ্গলমহলে অ্যাম্বুল্যান্স দিল, কবে থেকে সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে না সে সব আপনারা জানতে পারেন, কিন্তু আমি এ সব কিছুই জানি না।”
রোগীদের উপকারে না-এলেও অনেক অ্যাম্বুল্যান্স মাঝে মধ্যেই অন্য কাজে লাগছে বলে অভিযোগ। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ক্যাম্পাসে পড়ে থাকা অ্যাম্বুল্যান্সগুলো মাঝে-মাঝেই কে বা কারা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ কৈফিয়ত চাইছেন না। একমাত্র জেলায় মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরা এলে তাঁদের কনভয়ের পিছনে ওই অ্যাম্বুল্যান্স জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।” মাস কয়েক আগে বর্ধমানে মাটি উৎসবে আরও ৭টি অ্যাম্বুল্যান্স জঙ্গলমহলের জন্য বিলি করেন মমতা। সাংসদ তহবিলের টাকা থেকে এগুলিও দিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। ৪টি অ্যাম্বুল্যান্স দেওয়া হয় বাঁকুড়ার খাতরা অঞ্চলের চারটি স্থানীয় ক্লাবকে। তারা কী ভাবে অ্যাম্বুল্যান্সগুলি চালাচ্ছে, তার কোনও তথ্য নেই।
বাকি তিনটি দেওয়া হয় বাঁকুড়া স্বাস্থ্যবিভাগকে। একটি পাঠানো হয় গোরাবাড়ি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, একটি শিকরাবাদে ও একটি সুকুরে। এই তিনটি অ্যাম্বুল্যান্সের একটিও এখনও খাতায়-কলমে কাজ শুরু করেনি। স্বাস্থ্য দফতরের ট্রান্সপোর্ট বিভাগেও সেগুলি নথিভুক্তও হয়নি। কেন, উত্তর মেলেনি স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে। তবে এই অ্যাম্বুল্যান্সগুলি মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যায়, আবার ফিরে আসে বলে প্রশাসনিক সূত্রে খবর।
|