চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
গভীর অরণ্যে মিশেছে এক জটিল মায়াময় কুহক
ম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে কেতকী রায়চৌধুরীর একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। প্রায় ১২০টি ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘রিভার্স অ্যান্ড স্ট্রোক’। এই শিরোনামের কারণ হতে পারে এরকম যে কিছু ছবি তিনি এঁকেছেন কাচ বা স্বচ্ছ অ্যাক্রিলিক শিটের উপর বিপরীত প্রক্রিয়ায়। আর কিছু ছবি আঁকা হয়েছে তুলির টানে ক্যানভাস বা কাগজের উপর। এগুলি প্রকরণের সাধারণ লক্ষণমাত্র। এ থেকে ছবির নিহিত ভাবনা বা দর্শনের কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। দর্শককে সেটা খুঁজে নিতে হয়। এই শিল্পীর ছবির মূলগত বিষয় নিসর্গ। কিন্তু সেই নিসর্গ সরাসরি উপস্থাপিত নয়। বিমূর্তায়িত। প্রকৃতিকে বিদীর্ণ করে শিল্পী তাঁর নিজস্ব মননকে উদ্ভাসিত করতে চেষ্টা করেছেন। কেতকী শান্তিনিকেতন কলাভবনের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকে সেখানে তিনি চিত্রকলা অধ্যয়ন করেছেন। সেই পরম্পরার ধারায় তাঁর ছবি দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে।
নিসর্গরচনায় শান্তিনিকেতনের একটি নিজস্ব অভিমুখ আছে। কিন্তু কোনও একমাত্রিক ঘরানা বা প্রকাশভঙ্গি নেই। রবীন্দ্রনাথের ছবিকে শান্তিনিকেতনের ধারার অন্তর্গত করে না ভাবাই ভাল। যদিও শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি ও মানসমণ্ডল তাঁর অনেক ছবিতেই প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু তিনি স্বভাবতই স্বতন্ত্র। তবে শান্তিনিকেতনের চিত্রকলা রাবীন্দ্রিক আদর্শেরই উত্তরাধিকার। প্রথম পর্যায়ে একে দু’টি ধারায় ভাগ করা যেতে পারে। একটি ধারা নব্য-ভারতীয় রীতির আঙ্গিকে বিবর্তিত হয়েছে। এর শীর্ষে রয়েছেন নন্দলাল বসু। এই ধারার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ দেখা যায় ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মা, হীরাচাঁদ দুগার বা ইন্দ্র দুগার প্রমুখ শিল্পীর ছবিতে। আর একটি ধারা এই তথাকথিত ভারতীয়তার আঙ্গিককে অতিক্রম করতে চেষ্টা করেও প্রাচ্যচেতনাকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছে। এর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ছবি। আর রামকিঙ্কর তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র মূল্যবোধ প্রাচ্য প্রজ্ঞার সঙ্গে পাশ্চাত্যের অভিব্যক্তিবাদী ধারাকে সমন্বিত করে। এই দুই শিল্পীর আদর্শকে অনুসরণ করেই নিজস্ব রূপরীতি তৈরি করেছেন কে জি সুব্রামনিয়ন।
শিল্পী: কেতকী রায়চৌধুরী
এর পরবর্তী প্রজন্মের দু’জন শিল্পী সুহাস রায় ও যোগেন চৌধুরী। তাঁদের কেউই শান্তিনিকেতন পরম্পরার শিল্পী নন। কিন্তু শান্তিনিকেতন তাঁদের নিসর্গকে প্রভাবিত করেছে। এবং শিক্ষক হিসেবে তাঁরাও শান্তিনিকেতনের পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এর পরের প্রজন্ম থেকেই নিসর্গ ভাঙতে থাকে। জয়শ্রী চক্রবর্তী, ইন্দ্রপ্রমিত রায় থেকে শুরু করে একেবারে তরুণ শান্তনু মাইতি পর্যন্ত সেই বিমূর্তায়নেরই ধারাবাহিকতা।
কেতকী রায়চৌধুরীকে বলা যেতে পারে ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী। এই বিশ্বপ্রবাহের সৌন্দর্যকে সমগ্রতায় দেখে তিনি এর সারাৎসারকে রূপায়িত করতে চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতি তাই বিমূর্তায়িত হয়েছে। এর স্পন্দনটুকু শুধু ধরা পড়েছে। অনুপুঙ্খ বিশদ নয়। অজস্র রিভার্স পেন্টিং তিনি করেছেন। শান্তিনিকেতনে কে জি সুব্রামনিয়ন ও সুহাস রায় এই প্রকরণের চর্চাকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই শিল্পীর কাজে তার কিছু প্রভাব রয়েছে। যে ছবিটি আমরা এই লেখার সঙ্গে দেখছি, তা নীলিমা-ভারাক্রান্ত এক ঘন বনানীর নিসর্গ। অজস্র গাছপালা মিলেমিশে জটিল অন্ধকারের মায়াময় কুহক তৈরি করেছে। তার উপর বাইরে থেকে আলো এসে পড়েছে। তাতে ঝলমল করে উঠেছে অন্ধকার। অব্যক্ত, অসংজ্ঞায়িত এক সৌন্দর্যের পরিমণ্ডল তৈরি করেছে। আনন্দ ও বিষাদের জটিল বুনন জেগে উঠেছে।
বেশ কয়েকটি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ছবি এঁকেছেন শিল্পী। আঁধার ভেঙে প্রান্তিক সূর্যের লালিমাকে উদ্ভাসিত করেছেন। সেই ধ্যানমগ্ন সংবৃত উদাত্ততায় রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারের প্রতিফলন অনুভব করা যায়। একটি পর্যায়ের ছবিতে এই নিসর্গের ভিতর তিনি নারী-অবয়বকে সংস্থাপিত করেছেন। নিসর্গের অন্তর্মুখীনতার সঙ্গে মানবীপ্রতিমার রহস্যময়তাকে মেলাতে চেষ্টা করেছেন। ‘স্ট্রোকস’ পর্যায়ের ছবিতে ব্যবহার করেছেন দ্রুতসঞ্চারী প্রত্যয়ী তুলির টান। নন্দলাল ও রামকিঙ্করের প্রয়োগপদ্ধতিকে নিজের মতো করে রূপান্তরিত করে নিয়েছেন। নিসর্গের বিমূর্তায়নে তিনি নিজস্ব একটি অভিমুখ তৈরি করতে পেরেছেন। প্রয়োজন ছিল আরও একটু সংবৃত ও সংহত আত্মগত তন্ময়তা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.