কয়েক বছর আগেও নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। আত্মীয় ও পড়শিরা এড়িয়ে চলতেন। তবে কালচিনির সেই টোটোন দা এখন আত্মশুদ্ধির উপমা। কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চিকিৎসা-পরিচর্যায় সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফেরার পরে থেকে নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে রাস্তায় ঝাড়ু দেন ওই যুবক। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খুলে স্থানীয় নেশাগ্রস্তদের সুস্থ করে সঠিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। টোটোন দা ওরফে বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় থাকেন কালচিনির স্টেশনপাড়ায়। ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। আইন পড়ার জন্য নব্বইয়ের দশকে জলপাইগুড়ি আইন কলেজেও ভর্তি হন। কিন্তু মাঝপথে কলেজ ছেড়ে বাড়িতে ফিরে যান। ১৯৯৪ সালে চা বাগানে সামগ্রী সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। পরে চা বাগানে পরিস্থিতি খারাপ হলে ব্যবসা মার খায়। মদের খপ্পরে পড়েন। ৯৮ সাল নাগাদ নেশা এতটাই বেড়ে চলে যে দিনরাতের তফাত ঘুচে যায়।
৪৫ বছরের ওই যুবক জানান, দুই ছেলে-স্ত্রী কী খাবে খোঁজ রাখতেন না। এক সময় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাড়িতে ফিরবেন কিনা ঠিক ছিল না। প্রায় দিন পথচারীরা রাস্তার নালা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। পরিস্থিতি দেখে আত্মীয় ও পড়শিরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। কেমন করে ওই পথ থেকে ফিরে এলেন?
বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, “২০০৬ সালে এক বন্ধু পাশে দাঁড়ায়। নেশার কবল থেকে বাঁচাতে সে কলকাতায় নিয়ে বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা করে ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সুস্থ করে তোলে। ছয় মাস পরে ফিরে দেখি ছেলের পায়ের চপ্পলটা ছেঁড়া। কান্নায় বুক ফেটে যায়। বুঝতে পারি কী সর্বনাশ করেছি।” এর পরে নিজের মতো জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নেন তিনি। বোঝেন শুধু নিজে সুস্থ হলে হবে না। অন্য নেশাসক্তদেরও সুস্থ করতে হবে। ২০০৭ সালে ‘লাইফ ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন’ খুলে শুরু করে দেন স্থানীয়দের নেশামুক্ত করার কাজ। ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়লে তাই শিউরে ওঠেন বিশ্বজিৎবাবুর স্ত্রী সঙ্গীতা দেবী। তিনি বলেন, “সেই সব দিনের কথা ভাবতে গেসে এখনও কেন জানি ভয় হয়।”
কিন্তু নেশা ছেড়েও সহজে স্বস্তি মেলেনি। তিনি নেশামুক্ত অনেকেই মেনে নেননি। হাতেও কাজ ছিল না। বাবার কাছে থেকে লড়াই করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। এলাকার একটি মন্দিরের আশপাশ সাফাইয়ের কাজ শুরু করেন। ঝাড়ু কেনার পয়সা ছিল না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কিছু টাকা দিয়ে ঝাড়ু কেনার ব্যবস্থা করে দেন। এর পর নিয়মিত বাজার এলাকা পরিস্কার করার কাজ শুরু করেন ওই যুবক। এ জন্য পয়সা দাবি করেন না। প্রতিদিন সকাল পাঁচটায় উঠে প্রায় দু’ঘণ্টা কাজ করেন। এর পরে শুরু হয় ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের কাজ। তাঁর সংস্থার চেষ্টায় কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, কালচিনি, হ্যামিল্টনগঞ্জের অন্তত ৪৫ জনকে নেশামুক্ত করতে কলকাতা পাঠানো হয়। অনেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। কেন ঝাড়ু দেন? বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “আত্মশুদ্ধির জন্য ওই কাজ করি।” |