দায় নিয়ে চাপান-উতোর দেখভালে ত্রুটি, বণ্টনের
পথে ক্ষতি বৃদ্ধি বিদ্যুতে
কুশলতার জন্য কেন্দ্রেরও প্রশংসা পেয়েছে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। অথচ প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিক খাতে তাদের ক্ষতি ক্রমশই বাড়ছে। এখন বছরে এই ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা।
বছরখানেক আগেও এই ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় দক্ষতা দেখিয়েছিল বাংলা। তা সত্ত্বেও এ ভাবে ফের লোকসান বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, বণ্টন সংস্থা কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা ও নজরদারির অভাবেই বিদ্যুৎ ব্যবসায় রাজ্যের এতটা ক্ষতি হচ্ছে। একে পরিভাষায় বলে ‘এগ্রিগেট টেকনিক্যাল অ্যান্ড কমার্শিয়াল লস’ (এটিসি লস) বা প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিক ক্ষতি। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী যে-কোনও বণ্টন সংস্থায় এই খাতে ১৭ শতাংশ ক্ষতি হবেই। বিদ্যুৎ শিল্পে এই হারে ‘এটিসি লস’ হওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখন এই ক্ষতি দাঁড়িয়েছে গড়ে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয় হচ্ছে গড়ে ৭০ টাকা। রাজ্যের কোনও কোনও জেলায় আবার এই ক্ষতির পরিমাণ শতকরা ৪০ টাকা। বছর দুয়েক আগেও এটা ছিল ১০০ টাকায় ২৫ টাকার মতো।
বিদ্যুৎ-বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, অপরিকল্পিত ভাবে বিদ্যুতের লাইন টানলে অথবা সরবরাহ পরিকাঠামোর সংস্কার ঠিকমতো না-হলে ক্ষতির বহর বাড়ে। তাঁদের মতে, লাইনে ওভারলোড যত বাড়ে, বিদ্যুৎ সংবহনজনিত ক্ষতি বাড়তে থাকে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। উদাহরণ হিসেবে এক কর্তা বলেন, পাইপে অনেক দূরে জল নিয়ে গেলে ছোটখাটো ফুটো দিয়ে কিছু জল নষ্ট হয়। ফুটো বন্ধ করলে জল অপচয় অনেকটাই রোখা যায়। বিদ্যুতেও ঠিক তা-ই হয়।
ফুটো বন্ধ করা হচ্ছে না কেন?
বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, সাধারণত এটিসি লস কম থাকলে তা আরও কমানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই চেষ্টা জোরদার হয়নি। তাই ক্ষতির হার বাড়ছে। রাজ্য সরকারের হিসেব, এক শতাংশ ক্ষতি কমাতে পারলেই বণ্টন সংস্থা বছরে ৬৮ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে পারে। কিন্তু তা হচ্ছে না।
বণ্টন সংস্থা অবশ্য চেষ্টায় খামতির কথা মানতে রাজি নয়। সংস্থার কর্তাদের অভিযোগ, ক্ষতি যেটুকু বেড়েছে, তার দায় রাজ্য সরকারও এড়াতে পারে না। সরকারের বিভিন্ন দফতর এবং পুরসভাগুলির কাছেই অনাদায়ি রয়েছে কয়েকশো কোটি টাকার বিল। এ ছাড়া গত এক-দেড় বছরে গ্রামাঞ্চলে কয়েক লক্ষ বাড়িতে বিদ্যুতের লাইন দেওয়া হয়েছে। অনেক পরিবারই বিলের টাকা মেটাচ্ছে না। সেই ক্ষতির ধাক্কাও লাগছে বণ্টন সংস্থায়। বণ্টন সংস্থার বক্তব্য, টাওয়ার বসানোর জমি না-পাওয়ায় নতুন লাইন টানা যাচ্ছে না। কিন্তু সংস্থার গ্রাহক-সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এক কোটি ২৩ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। পুরনো ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ দিতে গিয়ে ওভারলোডের সমস্যা বাড়ছে। তার জেরেও বেড়ে চলেছে ক্ষতি। এক কর্তার ব্যাখ্যা, ঘনঘন টাওয়ার বসিয়ে নতুন লাইন টানতে পারলে ট্রান্সমিশন বা সংবহনজনিত ক্ষতি কমত। কারণ তখন ওভারলোড কমে যেত।
এর উপরে আছে বিদ্যুৎ চুরি। রাজ্যে নতুন সরকার এসে ফরমান জারি করে, তারা বিদ্যুতের মাসুল বাড়ানোর পক্ষপাতী নয়। সংস্থা বরং চুরি কমিয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করুক। কিন্তু চুরি ঠেকাতে গিয়ে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে মগরাহাটে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় দু’জনের। মাসুল বাড়াতে না-পেরে রুগ্ণ হয়ে পড়ে বণ্টন সংস্থা। পরে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মাসুল বৃদ্ধির অনুমতি দেয় সরকার। গত এক বছরে মাঝেমধ্যে মাসুল বাড়াতে পারলেও বাণিজ্যিক ক্ষতি কমানো যায়নি। বিদ্যুৎ চুরি ঠেকানোর অভিযান বন্ধ। বিদ্যুৎকর্তাদের বক্তব্য, এমন বহু জেলা রয়েছে, যেখানে ১০০ টাকার বিদ্যুৎ বিক্রি করে ৪০ টাকাও আসে না। সেখানে পুলিশ-প্রশাসন নিয়ে অভিযান চালিয়েও লাভ হয়নি। শুধু বেপরোয়া গ্রাহক নয়, বিদ্যুৎ চুরিতে বণ্টন সংস্থার এক শ্রেণির কর্মীরও হাত থাকে বলে কর্তারা জানান।
ফাঁকফোকর আছে নজরদারির কাজেও। যাঁরা গ্রাহকদের মিটার দেখেন, তাঁদের অধিকাংশই গড় বিল করে সংস্থার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। যথাযথ মিটার পরীক্ষা হচ্ছে না। ঠিকঠাক ‘বিলিং’ হচ্ছে না। বণ্টন সংস্থার অফিসারদের একাংশ বলছেন, গত এক-দেড় বছরে ম্যানেজার পদে ঘনঘন বদলির ফলেও কাজে ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কাজ বুঝতে না-বুঝতেই এক জনকে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর যোগফল হিসেবেই বাড়ছে এটিসি লস।
প্রশাসনের একাংশের অভিমত, বিদ্যুৎ ব্যবসায় সব রাজ্যেই এই ধরনের সমস্যা কমবেশি আছে। বাংলাতেও সেটা বেশি মাত্রাতেই ছিল। ২০০৭ সালের পর থেকে দক্ষতার সাহায্যেই তার মোকাবিলা করে এটিসি লস ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা গিয়েছিল। কিন্তু ফের তা বেড়ে ৩০ শতাংশ বা তারও বেশি হয়ে গিয়েছে। বণ্টন সংস্থার কর্তারা এর দায় এড়াতে পারেন না।
এখন তা হলে উপায় কী?
বিদ্যুৎকর্তাদের বক্তব্য, কড়া হাতে পরিস্থিতির সামাল দিতে না-পারলে ক্ষতি আরও বাড়বে। সরবরাহ ব্যবস্থায় পরিকল্পনামাফিক টাকা খরচ করে ওভারলোড কমাতে পারলে বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রযুক্তিগত ক্ষতি কমানো যায়। এতে গ্রাহকেরা ঠিক ভোল্টেজের বিদ্যুৎ পান, সংস্থারও ক্ষতি কমে। বণ্টন সংস্থার সেই দক্ষতা আছে বলেই কেন্দ্র অন্যান্য রাজ্যকে পশ্চিমবঙ্গের পথে চলার পরামর্শ দেয়। বণ্টন সংস্থা নিজেদের সেই নৈপুণ্যকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ফাঁকফোকর বোজাতে পারলে তাদের কোষাগারের স্বাস্থ্য আরও ভাল হতে বাধ্য বলে মনে করেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.