মোহনবাগান ১ (সাবিথ)
চার্চিল ব্রাদার্স ১
(সুনীল) |
চার্চিল ব্রাদার্সের জার্সি পরে নাচছিলেন ‘ফেলুদা’র ছবির নতুন তোপসেসাহেব ভট্টাচার্য!
সুব্রত ভট্টাচার্যের অভিনেতা ছেলে। সঙ্গে এনেছিলেন বোনকেও। সুনীল ছেত্রীর অতিথি হয়ে দেখতে এসেছিলেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ম্যাচ। ‘বন্ধুর’ গোলে আই লিগ! ‘সাহেব-মেম’ নাচবেনই তো। বাবা মোহনবাগানের ঘরের ছেলে, তাতে কী?
কোথা থেকে চলে এল একটা বিশাল শ্যাম্পেনের বোতল। সেটার মুখ খুলে চার্চিল আলেমাওয়ের এক ছেলে সফেদ ফেনা উড়িয়ে দিলেন আকাশে। যা ছড়িয়ে পড়ল সোনা-রুপোয় মোড়া ট্রফিটার উপর। মুক্তোর মতো ফোঁটা ফোঁটা হয়ে। বোতলে যেটুকু পড়েছিল, উপুড় করে খেতে শুরু করলেন পাগলের মতো। উদ্দাম নাচের ফাঁকে।
গ্যালারি জুড়ে উড়ছে অসংখ্য রক্তলাল পতাকা। রেড মেশিন-এর জয়োল্লাসের গর্বিত ধ্বজা। ততক্ষণে মাঠের মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে গোয়ান কনসার্ট। নাগাড়ে বাজছে। বেটো-সুনীল-হেনরিরা মাঝেমধ্যে এসে লাঠি নিয়ে জাজে ঘা দিয়ে যাচ্ছেন। বাজি ফাটছে অনর্গল। চার্চিল পরিবারের মেয়ে-বউরা এসে দলে দলে জড়িয়ে ধরছেন তাঁদের আই লিগ জয়ী ফুটবলারদের। গালে গাল ঘষে জানাচ্ছেন অভিনন্দন। সন্দীপ নন্দী চার্চিলের পতাকা নিয়ে পাগলের মতো ওড়াচ্ছেন। ট্রফি নিয়ে ভিকট্রি ল্যাপ দিচ্ছেন লেনি-ডেঞ্জিলরা। পিছনে ছুটছে লাল-জনতা।
তিনিসুভাষ ভৌমিক, ‘চার্চিল-কনসার্টের কন্ডাক্টর’ কোথায়?
‘মহানায়ক’ তখন ড্রেসিংরুমে একলা বসে। চশমার কাচ মুছছেন।
চতুর্থ রেফারি হাতে ধরা ইলেকট্রনিক বোর্ড মাথার উপর তুলে ‘ইনজুরি টাইম’ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভ বেঞ্চ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুভাষ। দেশের প্রথম কোচ হিসাবে দু’টি আলাদা ক্লাবকে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করার অনন্য রেকর্ড গড়ার পর নিউ আলিপুরবাসী মধ্যবয়স্ক বাঙালি শশার মতো ঠান্ডা। কিছুটা উদাসও। মাঠে ফিরলেন দুই চার্চিল-কন্যার হাত ধরে। তাঁদের একান্ত অনুরোধে। আর এসেই ঘটালেন বিস্ফোরণ।
“এত দিন সবাই বলত আমি নাকি তারকা ছাড়া টিমকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারি না। প্রমাণ হল জুনিয়রদের নিয়েও সুভাষ ভৌমিক ভারতসেরা হতে পারে।” মাথার উপর কে যেন জল ঢেলে দিল। তৃপ্ত সুভাষের মাথা থেকে তা গড়িয়ে পড়ল চোখেমুখে। “বিদেশের মাটিতে আসিয়ান কাপ জিতেছিলাম। সেটাই ছিল এত দিন আমার সেরা সাফল্য। সে বার জাতীয় লিগও জিতেছিলাম। ভাইচুং, ডগলাস, ওকোরোর মতো অনেক তারকা ছিল। কিন্তু কেউ ভাবেইনি জুনিয়রদের নিয়েও এ ভাবে সুভাষ ফিরে আসতে পারে। এ রকম একটা টিম নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া, বলতে পারেন জীবনের সেরা সাফল্য। আগের দু’টো জাতীয় লিগ জেতার চেয়ে অনেক কঠিন ছিল এ বারের জেতাটা। সব হয়ে গেল। বাকি থাকল শুধু এএফসি কাপটা জেতা।” |
সুভাষিত |
• কোচ হিসাবে সুভাষ ভৌমিকের আবির্ভাব ১৯৯১-এ মোহনবাগানে। সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও ধারাবাহিক কোচিং করেননি। শুধু ইস্টবেঙ্গলে ২০০২-’০৫, টানা তিন মরসুম থাকা ছাড়া। ওই তিন বছরে দু’টি করে জাতীয় লিগ আর আন্তর্জাতিক খেতাব-সহ লাল-হলুদকে দেন ১১টা ট্রফি। ২৩ বছরে মাত্র ছ’বছর ভারতীয় ফুটবল পেয়েছে কোচ সুভাষকে।
• ১৯৯১ মোহনবাগান (১) গভর্নর’স গোল্ড কাপ
• ১৯৯৯ ইস্টবেঙ্গল (১) কলকাতা লিগ
• ২০০২-০৩ ইস্টবেঙ্গল (৫) কলকাতা লিগ, ইন্ডিপেনডেন্স কাপ, ডুরান্ড কাপ, আইএফএ শিল্ড, জাতীয় লিগ
• ২০০৩-০৪ ইস্টবেঙ্গল (৩) জাতীয় লিগ, আশিয়ান কাপ, কলকাতা লিগ
• ২০০৪-০৫ ইস্টবেঙ্গল (৩) কলকাতা লিগ, ডুরান্ড কাপ, ফ্যান মিগেল কাপ
• ২০১২-১৩ চার্চিল ব্রাদার্স (১) আই লিগ |
পরিসংখ্যান: হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় |
|
ভিড়ের মধ্যে কেউ এক জন বলল, “বিলালকে আগে নামালে আমাদের এই টেনশনে পড়তে হত না।” শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, “চার্চিল আলেমাও-কে গিয়ে এটা বলে আসুন।” মাঠের ভেতর দলবল সমেত নেমে পড়া চাচির্ল প্রধানকে বলে আসবেন কী, প্রশ্নকর্তা যেন তখন পালানোর পথ খুঁজে পাচ্ছেন না! সারা মাঠই যে তখন সুভাষ-বন্দনায় অধীর।
প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সাবিথের একক প্রচেষ্টার গোলে চার্চিল ০-১ পিছিয়ে। নিস্তব্ধ তিলক ময়দান ধরে নিয়েছে প্রিয় দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়া পিছিয়ে গেল। অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্সে আক্রান্ত তখন পুরো গ্যালারি। দিল্লির ফুটবল হাউস থেকে উড়িয়ে আনা দুর্দান্ত ট্রফিটা ফের বাক্স বন্দি করে পুণে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন ফেডারেশন কর্তারা। আর এই অফুরান চাপের মুখে চার্চিল-টিডি কিনা চাইলেন, টিমের প্রাণভোমরা বেটোকে বসিয়ে আফগানিস্তানের কোনও এক বিলাল আরাজু-কে নামাতে! চার্চিল-প্রধান পর্যন্ত বেঁকে বসলেন। কোচের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে ফেললেন বিরতিতে। তা সত্ত্বেও গোয়ায় তাঁর কোচিং জীবন বাজি রাখলেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভোম্বলবাবু’।
কোচিং জীবনের সেরা চালটা এ দিনই সম্ভবত দিলেন সুভাষ। কাউকে তোয়াক্কা না করে ৬৪ মিনিটে বিলালকে পরিবর্ত নামিয়ে। ওই এক চালেই উধাও করিমের বাগানের যাবতীয় সুগন্ধ। বাঁ দিকের উইং দিয়ে আফগান কামানের ‘গোলাগুলি’ ছোড়া শুরু হতেই বাগান-প্রাচীর ভেঙে চৌচির। চার্চিলের এ মরসুমের বিখ্যাত ফরোয়ার্ড লাইন আরব সাগরের শান্ত ঢেউয়ের মতোই ধীরে ধীরে আছড়ে পড়তে শুরু করল বাগানে। গোললাইন থেকে বিনীশ বালানের হেড বাঁচালেন বিশ্বজিৎ সাহা। সারা মাঠে দীর্ঘশ্বাস। তিন্তু তার পরেই ডেঞ্জিলের ক্রস এসে পড়ল ভারত অধিনায়কের মাথায়। লাফিয়ে উঠেই হেড। ‘ফ্যান্টাসস্টিক’ বলে চিৎকার করে উঠলেন ‘সুভাষ-ব্রাদার্সের’ ম্যাচ দেখতে আসা জাতীয় কোচ উইম কোভারম্যান্স। ম্যাচ ১-১। চার্চিলের ঘরে এক পয়েন্ট। চ্যাম্পিয়ন হতেও ওই একটা পয়েন্টেরই তো দরকার ছিল সুভাষের। রিজার্ভ বেঞ্চের সঙ্গে গ্যালারিতেও বেজে উঠল বেটোর দেশের সাম্বার বোল‘ওলে ওলে ও।’ যা ট্রফি নেওয়ার পরেও দুলতে দুলতে গাইলেন সন্দীপ-সুনীল-বেটো-রাবাননরা।
আপনি কি ভেবেছিলেন এমন একটা ‘স্পেশ্যাল ডে’-তেও ম্যাচে পিছিয়ে পড়ে ড্র করবেন? বুক পকেটে রাখা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-মা সারদা’র ছবিতে হাত রাখলেন চ্যাম্পিয়ন কোচ। “বিশ্বাস করুন এক বারও ভাবিনি ফিরে আসতে পারব না। সব কৃতিত্ব ছেলেদের। জানতাম, আজই ছেলেরা চ্যাম্পিয়ন হবে,” বললেন সুভাষ।
তবে ম্যাচটা এ রকম তীব্র উত্তেজক হয়ে ওঠার পিছনে করিম বেঞ্চারিফার মস্তিষ্কের প্রশংসা করতেই হবে। নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি আর গেম রিডিং-এ তিনি সুভাষকে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন প্রথমার্ধে। তিন জন সেন্ট্রাল মিডিও রেখে ৪-৩-২-১ ফর্মেশনে চলে গিয়েছিলেন মোহনবাগানের মরক্কান কোচ। বেটোর পিছনে কুইনটন, হেনরির পিছনে ইচেকে লাগিয়েছিলেন। গোলও করে ফেলল সাহসী মোহনবাগান। সাবিথের ইনসাইড ডজে কেটে গিয়েছিলেন রাবানন। কিন্তু ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’ যে, সেটা বুঝতে পারেননি করিম। পাল্টা চালে সুভাষ তাঁকে বোঝালেনদশ বছর পর নজিরবিহীন ভাবে কোচিংয়ে ফিরে এসেও ভারতসেরা হওয়া যায়। বোঝালেন তিন বার আই লিগ, আসিয়ান কাপ-সহ অসংখ্য ট্রফি জেতার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসা সুভাষ ভৌমিক ওস্তাদেরও ওস্তাদ।
বেটো থেকে সুনীল, সন্দীপ থেকে রাবাননসবার দিকে ম্যাচের পর প্রশ্ন উড়ে যাচ্ছিল, সাফল্যের রসায়ন কী?
উত্তরে উঠে এল স্রেফ দু’টো কথা, টিমের একতা আর টিডিসুভাষ ভৌমিক।
ইতিহাস গড়া সুভাষ অবশ্য ততক্ষণে নিজের গাড়িতে উঠে বসেছেন। তাঁর যে আর নতুন করে দেখানোর কিছু নেই! |