বাস থেকে ধাক্কা বৃদ্ধকে |
‘ছেলের দল ফেলে দিল
আমার স্বামীকে’
কাবেরী গুহ
(বালিতে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া বৃদ্ধ সুকেশ গুহ’র স্ত্রী) |
|
|
দৃশ্যটা এখনও ভুলতে পারছি না। সন্তানের বয়সী কয়েকটি ছেলের অভব্যতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার স্বামীকে যে এ ভাবে মাসুল দিতে হবে, ভাবতেও পারিনি।
ভিড় বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পর থেকেই তিনটে ছেলে আমার স্বামীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছিল। কেউ প্রতিবাদ করছিলেন না। রাসবাড়িতে আমি বাস থেকে নামলাম। তার পরে একটু এগিয়ে গেল বাসটা। হঠাৎ দেখি, বাস থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়লেন আমার ৬৮ বছরের স্বামী। বাসটা ওঁর পা পিষে দিয়ে চলে গেল। ছুটে গিয়ে দেখি মুখ, মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছে। সাড়া নেই। বাঁ পা-টা থেঁতলে গিয়েছে। আমার চিৎকারে আশপাশের কিছু ছেলে ছুটে এল। অন্যেরা ছুটল বাসটার পিছনে।
চোখে মুখে জল ছিটিয়েও আমার স্বামীর জ্ঞান ফিরছিল না। ওঁকে তুলে নিয়ে পাড়ার কয়েক জন হাসপাতালে গেলেন। এরই মধ্যে এল পুলিশ। দেখি বাসটাও দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
হাসপাতালে গিয়ে দেখি, স্বামীর জ্ঞান ফিরেছে। মাথায় সেলাই হচ্ছে। পায়ের হাড় ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছে। রাতে ওঁকে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারেরা বলেছেন, পায়ে অপারেশন করতে হবে। মাথাতেও আঘাত লেগেছে। মোট ৯টা সেলাই পড়েছে। মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে।
বলতে পারেন, এটা কেমন সমাজ? বাসে অত লোকের সামনে এতক্ষণ ধরে ছেলেগুলো আমার স্বামীকে গালাগালি দিল, আজেবাজে কথা বলল, কেউ প্রতিবাদ করল না। তাঁদের হুঁশ ফিরল, যখন আমার স্বামীকে ছেলেগুলো বাস থেকে ফেলে দিল। কন্ডাক্টর বা বাসযাত্রীরা প্রথমেই যদি প্রতিবাদ করতেন, তা হলে হয়তো ওঁকে এত কষ্ট পেতে হত না! |
হাসপাতালের শয্যায় সুকেশ গুহ। ছবি: শান্তনু ঘোষ। |
সোমবার বিকেলে আমি আর আমার স্বামী সুকেশ গুহ গিয়েছিলাম সালকিয়ার হরগঞ্জ বাজারে। সাড়ে ৬টা নাগাদ ফেরার বাস পাচ্ছিলাম না। শেষে ৫৬ রুটের এই বাসটা এল। ভিড় সত্ত্বেও উঠে পড়লাম। আমার কিডনির সমস্যা, আমার স্বামীর কোমরে বড় চোট। দু’জনেই বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারি না। কিন্তু কী করব! কে জায়গা ছাড়বে! সামনে তিনটি অবাঙালি ছেলে ও একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জয়সোয়াল হাসপাতালের সামনে চালকের পাশের আসনে জায়গা ফাঁকা হল। কোনও মতে সেখানে বসলাম। এর পরেই আমার সামনে আরও দুটো সিট ফাঁকা হল। আমার স্বামী বসতে গেলে ‘‘আমরা আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছি’’ বলে ছেলে দুটো ঝপ করে বসে পড়ল। এর পরে লিলুয়া ছোট গেটের সামনে আমার পাশের মহিলা উঠে গেলেন। তাঁর পায়ের চাপে আমার নতুন চটিটা খুলে বাসের পা-দানিতে পড়ে গেল। আমার স্বামী চটিটা তুলতে গিয়ে প্রচণ্ড ভিড়ে হাতড়াচ্ছিলেন। তখনই দরজার সামনে দাঁড়ানো চেক শার্ট পরা, দাঁত উঁচু ছেলেটা আমার স্বামীকে হিন্দিতে বলল, ‘‘লজ্জা করে না? এই বুড়ো বয়সে মহিলাদের গায়ে হাত দিচ্ছ?’’ আমার স্বামী রেগে গিয়ে ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘‘আমি তোমার বাবার বয়সী। এ সব কী বলছ?’’
ওই ছেলেটা আর ভিতরে থাকা ছেলে দুটো ওঁকে অকথ্য গালিগালাজ করতে লাগল। দরজায় দাঁড়ানো ছেলেটা তো এক বার মারতেও গেল। তাতে আমার স্বামী আরও খেপে গেলেন। অবাক হয়ে দেখি, এক জন বৃদ্ধকে ওরা এত অপমান করছে, কেউ প্রতিবাদ করছেন না! কন্ডাক্টরকে বলেও লাভ হল না। আজ শুনলাম, মহম্মদ হুসেন ও মহম্মদ ফিরোজ নামে দুটো ছেলেকে পুলিশ ধরেছে।
রাসবাড়ি স্টপেজ আসতেই আমি নেমে যাই। দেখলাম আমার স্বামীকে ফের বাজে কথা বলল দরজার সামনে দাঁড়ানো ওই ছেলেটা। আশ্চর্যের বিষয়, আমি নামার পরেই বাসটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। এর পরে কিছুটা এগোতেই সেই দৃশ্য! এখনও আমার গা শিউরে উঠছে! |