|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
জালিয়াতের হাতে না পড়ে উপায় কী |
কেন্দ্রীয় সরকার আর ক্ষুদ্রসঞ্চয়ে উৎসাহ দিতে রাজি নয়। ব্যাঙ্কগুলোও সামাজিক দায়িত্ব ভুলতে বসেছে।
ফলে গ্রামাঞ্চলে আর্থিক ক্ষেত্রে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেই ফাঁক গলেই ভুঁইফোঁড় সংস্থার রমরমা।
অভিরূপ সরকার |
সুদীপ্ত সেন কেলেঙ্কারির পাঁকে রাজনৈতিক নেতারা যতই নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছেন, ততই যেন এই বিপর্যয়ের অর্থনৈতিক পটভূমিকা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, যে-পটভূমি না থাকলে এই রকম বিরাট একটা কেলেঙ্কারি সম্ভবত ঘটতে পারত না। আসলে একটা নয়, ঘটনা দুটো। একটা গত দশকে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে ঘটে গেছে। আর একটা পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটল।
ঘটনা দুটির উৎপত্তি কিন্তু একই অর্থনৈতিক কারণগত। পূর্ব ভারতে যেমন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে লোক-ঠকানো আমানত সংগ্রহ সংস্থা, তেমনই অন্ধ্রপ্রদেশ ভুঁইফোঁড় মাইক্রোফিনান্স সংস্থায় ছেয়ে গিয়েছিল। ভুঁইফোঁড় আমানত সংগ্রহ সংস্থাগুলি অবাস্তব সুদের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা জমা নিয়ে স্রেফ মেরে দিচ্ছে। |
|
অবহেলা। ডাকঘর বা ব্যাঙ্কে নিরাপদে টাকা রাখার সুযোগ গ্রামাঞ্চলে ক্রমেই কমছে। |
পক্ষান্তরে, মাইক্রো ফাইনান্স সংস্থাগুলো অতি চড়া সুদে গরিব মানুষকে টাকা ধার দিচ্ছিল এবং তার পর, তাদের সকলে না হলেও অনেকেই, লাঠিসোটা নিয়ে ভয় দেখিয়ে, বলা যেতে পারে গলায় পা দিয়ে অসহায় মানুষগুলোর কাছ থেকে টাকা আদায় করছিল। তা সত্ত্বেও যাঁরা টাকা শোধ করতে পারছিলেন না, তাঁদের পুরনো ধারগুলোকেই নতুন ধার হিসেবে দেখানো হচ্ছিল, ব্যাঙ্কিং-এর ভাষায় যার নাম এভারগ্রিনিং। ২০১০ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার প্রথম অর্ডিন্যান্স ও পরে আইন করে মাইক্রো-ফাইনান্স সংস্থাগুলির কাজকর্ম প্রায় বন্ধ করে দেয়। ২০১১ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্যোগে প্রকাশিত মালেগম রিপোর্ট ও কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মাইক্রো-ফাইনান্স বিল ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোকে ক্রেতা সুরক্ষার দিকে নজর দিতে কিছুটা বাধ্য করেছে।
|
আসল সমস্যা রয়েই গেল |
মুশকিল হল, এক দিকে ব্যাঙ্কগুলো গ্রামের গরিব মানুষদের কাছে পৌঁছতে পারছে না, আর অন্য দিকে সরকারি ঋণ কমানোর ব্যাপারে কেন্দ্রের অনর্থক বাড়াবাড়ির ফলে ডাকঘরের স্বল্প-সঞ্চয়ে কেন্দ্র আর তেমন উৎসাহ দিচ্ছে না। ব্যাঙ্কের দুটো কাজ টাকা জমা নেওয়া এবং টাকা ধার দেওয়া। ডাকঘরও চিঠি বিলি করার সঙ্গে সঙ্গে, কিছু দিন আগে পর্যন্ত এই কাজটাই করে আসছিল। প্রত্যন্ত গ্রামে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা না পৌঁছনোর ফলে এবং স্বল্প-সঞ্চয়ে উৎসাহ কমিয়ে দেবার কারণে প্রথম কাজটা চলে যাচ্ছে জালিয়াত লগ্নি সংস্থাগুলোর দখলে, আর দ্বিতীয় কাজটা করার ছুতোয় মাইক্রো ফাইনান্স নাম নিয়ে কিছু সংস্থা মহাজনী কারবার চালাচ্ছে। এর ফলে বড় দুটো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এক, সরাসরি মারা পড়ছে গ্রামের গরিব মানুষ। হয় জোচ্চোরদের হাতে টাকা জমা রাখার ফলে সর্বস্ব খোয়া যাচ্ছে, না হয় মহাজনের টাকা শোধ করতে গিয়ে তাঁরা ধনে-প্রাণে মারা পড়ছেন। দুই, যে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশের আর্থিক উন্নতিতে কাজে লাগতে পারত, সেই দুর্বত্তদের হাতে পড়ে কিছু বিলাসব্যসনে খরচ হয়ে যাচ্ছে, আর বাকিটা অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনও ব্যবসায় নিয়োগ করা হচ্ছে।
২০১২ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্ট বলছে, যেখানে উন্নত দেশগুলিতে নব্বই শতাংশেরও বেশি মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, সেখানে আমাদের দেশে রয়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। অনুপাতটা গ্রামে আরও কম। বস্তুত, সারা ভারতে ৪০ শতাংশ এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ৬০ শতাংশ গ্রামবাসীর কাছে এখনও ব্যাঙ্ক-পরিষেবা পৌঁছতে পারেনি। এই অবস্থায় যদি গরিব মানুষ নিরুপায় হয়ে ভুঁইফোঁড় সংস্থাদের হাতে টাকা গচ্ছিত রাখেন, তার জন্য আর্থিক নীতি-নির্ধারকদের ব্যর্থতা অবশ্যই দায়ী। এখানে দুটো প্রশ্ন উঠছে এক, কেন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছতে পারছে না? দুই, পৌঁছতে পারলেই কি জালিয়াত সংস্থাগুলোর দৌরাত্ম্য ঠেকানা যেত?
|
আইন চাই, ব্যাঙ্কও |
বেশ কিছু দিন যাবৎ উদারীকরণ নীতির অঙ্গ হিসেবে ব্যাঙ্ক ব্যবসায় মুনাফাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বছরের শেষে যে-ব্যাঙ্ক যত বেশি লাভ রাখতে পারছে, তার তত কদর। সমস্যা হল, লাভের দিকে নজর রাখতে গিয়ে ব্যাঙ্করা তাদের সামাজিক দায়-দায়িত্বগুলো প্রায় ভুলতে বসেছে। প্রত্যন্ত গ্রামে শাখা খুললে যেহেতু তেমন লাভ নেই, তাই গ্রামীণ শাখা বিস্তারে তেমন উৎসাহ ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। হাল আমলে অবশ্য দূরের গ্রামে শাখা না খুলেও কেমন করে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কিছু ভাবনাচিন্তা করেছে। বিজনেস করেসপন্ডেন্ট নামক একটি প্রকল্প তৈরি হয়েছে, যেখানে ব্যাঙ্কের কোনও প্রতিনিধি একটি হস্তচালিত যন্ত্র এবং কিছু নগদ টাকা নিয়ে দূরবর্তী গ্রামগুলোতে নিয়মিত পৌঁছবেন এবং তাঁর সহায়তায় গ্রামের মানুষরা টাকা তোলা ও টাকা জমা রাখার কাজ সম্পন্ন করবেন। প্রকল্পটি খুব বেশি দূর এগোয়নি। ব্যাঙ্কগুলোর দিক থেকে উদ্যোগের অভাব আছে। আরও একটা কারণ আছে শোনা যাচ্ছে, বিজনেস করেসপন্ডেন্ট বলে ব্যাঙ্কগুলো যাদের নিয়োগ করেছিল, তাদের অনেকেই ছিল একই সঙ্গে ভুঁইফোঁড় লগ্নি সংস্থার এজেন্ট। ব্যাঙ্কের প্রকল্প সফল করতে তাদের তেমন উৎসাহ ছিল না।
এখানেই দ্বিতীয় প্রশ্নটি ওঠে। জালিয়াত সংস্থাগুলো যেখানে বিপুল পরিমাণ কমিশন ও সুদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেখানে ব্যাঙ্কে টাকা রাখা বা রাখানোর জন্য চেষ্টা করার উৎসাহ মানুষের থাকবে কেন? অর্থাৎ, চিটিংবাজরা যেখানে রমরমিয়ে ব্যবসা করছে, সেখানে ব্যাঙ্কের উপস্থিতি থাকা, না-থাকা সমান। এখানে ভুঁইফোঁড়দের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। খবরে প্রকাশ, চিনে ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪০০টি ভুঁইফোঁড় লগ্নি সংস্থার মালিককে গ্রেফতার করে হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আর না-হয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশেও কঠোর আইন অবশ্যই দরকার। কিন্তু, শুধুমাত্র যদি কড়া আইন তৈরি হয়, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে ব্যাঙ্কগুলোর উপস্থিতি পর্যাপ্ত না হয়, তা হলে একটা শূন্যতা থেকেই যাবে, যে-শূন্যতার সুযোগ নিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে গলে ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
|
বাজার যা পারে না |
এ বার ডাকঘরের স্বল্প-সঞ্চয় নিয়ে দু-চার কথা। কয়েক বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গে বিপুল পরিমাণ স্বল্প-সঞ্চয় জমা হত, এখন হয় না। নিশ্চয় এই হ্রাসপ্রাপ্ত স্বল্প-সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ জালিয়াত সংস্থাগুলোর কাছে জমা পড়েছে। কিন্তু এর পেছনে যে শুধুমাত্র সেগুলোর প্রলোভন রয়েছে তা নয়, কেন্দ্রীয় সরকার রীতিমতো পরিকল্পনা করে স্বল্প-সঞ্চয়ের প্রকল্পগুলোকে অনাকর্ষক করে তুলেছে। স্বল্প-সঞ্চয় আসলে জনগণের কাছ থেকে নেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ। সরকার এই ঋণ আর নিতে চায় না। তারা মনে করছে, সরকারি ঋণ বাড়তে থাকলে বাজারে বেসরকারি ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঋণের জোগান কমে যাবে, ফলে বেড়ে যাবে সুদের হার। সুদের হার বেড়ে গেলে বেসরকারি পুঁজিপতিদের মুনাফা কমে যাবে, ধস নামবে শেয়ার বাজেরে। সরকার এই সব চায় না। তারা ভাবছে, সব থেকে আগে বেসরকারি পুঁজিপতিদের উৎসাহ দেওয়া দরকার। বেসরকারি কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেলে কর-সংগ্রহ নিজের থেকেই বেড়ে যাবে। তখন জনসাধারণের কাছ থেকে ধার করারও আর দরকার পড়বে না।
অর্থাৎ, উদার ব্যাঙ্কনীতির মতো এখানেও অতি দক্ষিণ চিন্তার একটা প্রলম্বিত ছায়া দেখতে পাচ্ছি। যে চিন্তা আমাদের বিশ্বাস করতে বলছে, সব সমস্যা বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিলে নিজের থেকেই সমাধান হয়ে যাবে। আর গরিবদের জন্যেও আলাদা করে ভাবার কিছু নেই, বাজারই উদ্ধার করবে তাদের। কঠিন বাস্তব কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছে। |
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা-য় অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|