সারদা জালিয়াতি একটি আর্থিক অপরাধ। সেটা ক্রমেই অর্থনীতিঘটিত রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠছে। মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় এটাকে উল্টিয়ে ব্যবহার করছেন, অর্থনীতি নির্ধারণ করতে রাজনীতির পদ্ধতিতে মোকাবিলা করছেন।
দেবেশ রায় |
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দলের একমাত্র নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ভয়ঙ্কর মারাত্মক ভুল করে চলেছেন। এই ভুল যে গণতান্ত্রিক সিস্টেম মানে সরকার। তাঁর ভুলগুলো কোথায়?
১. তিনি বিধানসভার আইন তৈরির অধিকারকে অর্থাৎ এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তাঁর সরকারের ও দলের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। পূর্ববর্তী বিধানসভায় গৃহীত বিল বর্তমান বিধানসভার সদস্যদের জানাননি। কেন্দ্রের কাছে ন্যস্ত সেই বিল প্রত্যাহারের কোনও কারণ জানাননি। নতুন আইন প্রস্তাব করেছেন। এটা করার সংখ্যাগরিষ্ঠতাটুকু তাঁর আছে। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিনি অপব্যবহার করেছেন।
২. ৪ মে-র ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় হাইকোর্টে একটি মামলায় রাজ্য সরকারের হলফনামার যে ফটোকপি ছাপা হয়েছে, তাতে প্রমাণ হয় যে, মুখ্যমন্ত্রী সারদা-কাণ্ড সম্পর্কে তাঁর ও সরকারের অবগতির যে পঞ্জি দিয়েছিলেন, তা ভুল ও বেঠিক। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সতর্কবার্তার কোনও মূল্য রাজ্য সরকার দেয়নি। এর ফলে কার্যত রাজ্য সরকার সারদা কাণ্ডের সহযোগী হয়ে পড়ে।
৩. ২ এবং ৩ মে যথাক্রমে শ্যামবাজার পাঁচমাথায় ও ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, যথাক্রমে, আরাবুল ও কুণাল-মদন-সৃঞ্জয়-মুকুলদের নাম করে কার্যত এঁদের সম্পর্কে আদালতের মামলায় ও সারদা-তদন্তে উল্লিখিত অভিযোগের বিরুদ্ধ মত দিয়েছেন। তিনি তা পারেন না, কারণ তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
৪. ওই দুই সভাতেই তিনি তাঁর শাসনকালে সংঘটিত ঘটনার দায় পূর্ববর্তী সরকারের ওপর চাপিয়েছেন। এতে এটাই প্রমাণিত হয়, তিনি তাঁর শাসনকালে যে অপরাধ ঘটেছে, তার দায় নিচ্ছেন না। সেই দায় এড়াতে দলকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে বিপক্ষীয় দলের (সি পি আই এম) সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্মুখযুদ্ধে প্ররোচিত করছেন।
সারদা জালিয়াতি একটি আর্থিক অপরাধ। সেটা ক্রমেই অর্থনীতিঘটিত রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠছে। এই প্রক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সাবালকতার প্রমাণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটাকে উল্টিয়ে ব্যবহার করছেন অর্থনীতি নির্ধারণ করতে রাজনীতির পদ্ধতিতে মোকাবিলা করছেন। এটা তাঁর সর্বনাশা ভ্রান্তির প্রমাণ। |
সারদার জালিয়াতির মূলটা বোঝা দরকার। ২৯ এপ্রিল ‘অল ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব চিট ফান্ডস’ একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, সারদা কোনও সংজ্ঞাতেই চিট ফান্ড নয়। ‘চিট ফান্ড অ্যাক্ট’ (১৯৮২) অনুযায়ী চিট ফান্ডগুলিকে ‘রেজিস্ট্রার অব চিট্স’-এর কাছে নথিভুক্ত হতে হয় ও নিজের নামের সঙ্গে ‘চিট ফান্ড’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়। ১০,০০০ চিট ফান্ড ভারতে নথিভুক্ত, তারা বছরে ত্রিশ হাজার কোটি টাকার আইনসঙ্গত ব্যবসা করছে। চিট ফান্ডের আমানত নেওয়ার অধিকার নেই। তারা নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে একই ব্যক্তির কাছ থেকে একই পরিমাণ অর্থ (সাবস্ক্রিপশন) সংগ্রহ করেন। অর্থাৎ সারদা কোম্পানি সেজে চিট ফান্ডের মতো কাজ করেছে। এটা ফৌজদারি অপরাধও বটে।
সারদা যে ধরনের জালিয়াতি বা জোচ্চুরি করেছে, তেমনটি প্রথম ঘটল না। প্রথম ঘটেছে বামফ্রন্টের আমলে, না তৃণমূলের আমলে এই তর্কে যাঁরা ফাঁসছেন, তাঁরা কাঠের ঘানির সরষে তেলের শুদ্ধতা-বিশ্বাসীর ঠুলি পরা।
যে টাকা ছড়ানো আছে, তা গুছিয়ে এনে পুঁজি বানানোর লক্ষ্যে এই বাংলাতেই এক সময় কত ব্যাঙ্কের জন্ম হত সময়মতো ফেল হওয়ার জন্য, সে তো খুব বেশি পুরনো কথা নয়। কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, নোয়াখালি ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, ভারতী সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, এ সব নাম কি ভুলে যাওয়ার? এই ব্যাঙ্কগুলি যাঁরা শুরু করতেন, তাঁরা সুদীপ্ত সেনের চাইতে হাজার গুণ নামজাদা মানুষজন। সে দিনই পড়লাম কুমিল্লার দত্তবাড়ির এক স্মৃতিকথা। এই সব ব্যাঙ্কের সমর্থক হিসেবে প্রচারিত হত বিশিষ্ট সব মানুষের নাম, তাঁরা কেউ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, কেউ অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদাসীন অফিসার, কেউ কোনও দেশীয় রাজ্যের দেওয়ান, আবার কেউ বাংলার বিখ্যাত বংশানুক্রমিক জমিদার। এই সব নাম প্রচারিত হত আমানতকারীদের ভরসা দিতে। এই সব ব্যাঙ্কের টাকায় খবরের কাগজ, ম্যাগাজিনও বেরত। যখন ব্যাঙ্ক ডুবত, আনুষঙ্গিক উপচারগুলিও ডুবত।
ব্যাঙ্ক ফেলের প্রচলিত ব্যাবসা সামলাতে সব ব্যাঙ্ককে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আওতায় আনা হল। ব্যাঙ্কের আমানত বাঁচানোর জন্য দায়ী থাকল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্কগুলো দায়ী থাকল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে। ব্যাঙ্ক খুলতে হলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি নিতে হবে, রোজকার হিসেব রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে জানাতে হবে। তখন ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হয়নি, ব্যাঙ্ক-ব্যাবসার কেন্দ্রীকরণ হয়েছে।
ইনশিয়োরেন্স ব্যবসার ইতিহাসও এক। তাতে আরও একটু স্বার্থ ছিল মালিকদের। প্রথম পলিসি দেওয়ার পর পলিসি আর চালাতে না পারার দায় বর্তাত খদ্দেরের কাঁধে। বাজেয়াপ্ত প্রথম পলিসিই হত কোম্পানির অর্থাৎ মালিকদের সংগৃহীত পুঁজি। অজস্র বিমা কোম্পানি, অজস্র এজেন্ট। সেই দেশবিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম। সেই খবরের কাগজ। বিমা ব্যাবসা ছিল ব্যাঙ্ক ফেল করানোর ব্যাবসার থেকে আধুনিক, জটিল ও নিরাপদ। এর সবচেয়ে প্রতিপত্তির সময়ে প্রদেশে প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন চালু হয়েছে। সে সব সরকারের মন্ত্রীরাও এ ব্যাবসার শিরোমণি হতেন।
সুতরাং সারদার মালিক শাস্ত্রসম্মত ভাবেই নিজেকে যুধিষ্ঠির বলে দাবি করতে পারেন। ধর্ম-বক যুধিষ্ঠিরকে জেরা করেছিলেন: পথ বলে কাকে? যুধিষ্ঠির জবাব দিয়েছিলেন: মহাজনরা যে পথে গেছেন। সুদীপ্ত সেনও বলতে পারেন, তাঁকে মহাজনরাই পথ দেখিয়েছেন। তিনি দেশের ভিতরে ছড়িয়ে থাকা টাকা গুছিয়ে একত্র এনে পুঁজি বানিয়েছেন। নানা কোম্পানির সাইনবোর্ড না টাঙালে লোকে টাকা দেবে কেন? টাকাটা তো একটা লোকের নিজের টাকা। নিজেরই বুদ্ধিতে সে টাকা সে খাটাবে। কারও মনে হতে পারে, মোটর সাইকেল তৈরির কারখানায় টাকা খাটালে টাকা তাড়াতাড়ি বাড়বে, বেশি করে বাড়বে, বেশি বেশি বাড়বে, ঘনঘন ফেরত আসবে। কারও মনে হতে পারে, আবাসন তৈরির কারবারে টাকা বর্ষার কচু গাছের মতো বাড়বে। অনেকেই তো একটার জায়গায় দু’টো ফ্ল্যাট কিনে রাখছেন। যিনি টাকা দিচ্ছেন তিনি তো আর মোটর সাইকেল কারখানা বা আবাসন দেখতে যাচ্ছেন না। তিনি নিজের টাকা খাটাতে দিয়েছেন। সেই টাকা বহুগুণ হয়ে ফিরে আসবে বলে।
ঠিক এইখানেই সারদা-জালিয়াতিতে একটা ভুল জায়গায় জোর পড়ছে। খেটে খাওয়া মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকা সারদা লুট করেছে, এই একতরফা দোষারোপে সারদার অপরাধ বহুগুণিত, বহুকলঙ্কিত ও নৈতিক শোনায় বটে, কিন্তু তাতে সারদার সংগৃহীত বিপুল অর্থের ব্যাখ্যা মিলবে না। এত টাকা দৈনিক উপার্জনকারী বা অনাহারী সঞ্চয়কারীর আঁচলে বাঁধা বা প্যান্টের গোপন পকেটে রাখা ভাঁজ করা টাকা হতে পারে না। সারদার আমানতকারীদের মধ্যে অঘোষিত বড় টাকা নিশ্চয়ই খাটছে। নিশ্চয়ই আছে।
আমাদের আধুনিক সামাজিক জীবনে নিরাপদে বেঁচে থাকার, ছেলেমেয়েদের যোগ্য শিক্ষা দেওয়ার, বেঁচে থাকার স্টাইল ও কোয়ালিটি বদলানোর দরকার প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ফলে মেডিকেয়ার, প্রাইভেট স্কুল-কলেজ, লাইফস্টাইল ব্যবসা ও টুরিং এজেন্সি, এই ব্যাবসাগুলি বেড়েছে। বেড়েছে শুধু নয়, হুহু করে বেড়েছে ও প্রত্যেকটি ব্যাবসার নানা স্তর আছে।
আমাদের রোগী ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ছাত্রছাত্রী ও বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, বেড়ানো ও বিশেষজ্ঞ ব্যবস্থাপক ইত্যাদির অনুপাত ভয়ঙ্কর রকম অসমান। এক জন তত নাম না করা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরও বিভিন্ন চেম্বারে ও নার্সিং হোমে দৈনিক আয়, চোখের হিসেবেও কুড়ি হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। স্কুলশিক্ষকদের টিউশন বা কোচিং ক্লাসের আয়ও দৈনিক ও রকমই। এগুলো তো উদাহরণ মাত্র। এত স্বাধীন টাকা যদি প্রতিদিন উড়ে বেড়ায়, যাঁরা আয় করেন তাঁরা যদি ট্যাক্স দেওয়াটাকে ভাবেন অন্যায় কাজ, তা হলে ধর্মপুত্র হিসেবে সুদীপ্ত সেন বলে যদি কেউ না-ও থাকেন, এই অগুনতি টাকার মালিকরা এক জন সুদীপ্ত সেন তৈরি করে নেবেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় স্বীকার করে ফেলছেন সুদীপ্ত সেন তৈরিতে তাঁর স্বার্থও আছে, হাতও আছে। |