জেলখানার আদলে রাতের খাবার খাইয়ে, মাথা গুনতি করে রবিবার সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই ওয়ার্ডের দরজায় তালা ঝুলিয়ে চলে গিয়েছিলেন সকলে। সোমবার আটটা নাগাদ সকালের শিফ্টের কর্মীরা তালা খুলতে এসে দেখেন, মহিলা ওয়ার্ডের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভিতরে শিশুর কান্নার শব্দ। ভিতরে ঢুকতেই নজরে পড়ল, ঘরের কোণে নেতিয়ে পড়ে আছেন মিনতি বর্মণ নামে এক রোগিণী। তাঁর কোলের কাছে এক সদ্যোজাত শিশু। ওয়ার্ডের অন্য রোগিণীরা নার্সকে জানালেন, রবিবার রাতে ওয়ার্ডের ভিতরেই সন্তান প্রসব করেছেন ওই রোগিণী। ঘটনাস্থল, পাভলভ মানসিক হাসপাতাল।
রবিবার রাতে প্রসব হলেও সোমবার রাত পর্যন্ত শিশুটি ওই হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডের মেঝেতেই পড়ে রয়েছে। পাভলভ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা মা ও সদ্যোজাতকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে তাঁদের প্রত্যাখান করা হয়েছে।
এ দিন সকালে ওয়ার্ডে ঢুকে সদ্যোজাত শিশুটিকে মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই দেখেছেন নার্স ও অন্য কর্মীরা। তা হলে নাড়ি কী ভাবে কাটা হল? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের কর্মীদের অভিযোগ, সুভাষচন্দ্র রায় নামে যে চিকিৎসকের অধীনে মিনতি ভর্তি রয়েছেন, তাঁকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি পাল্টা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, “মিনতির অন্তঃসত্ত্বা থাকার খবর তো আমি জানতামই না।”
গত জানুয়ারি মাসে মিনতি এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে যাঁকে প্রতি দিন তিনি দেখছেন, তাঁর শরীরের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর কেন তাঁর কাছে নেই, কেন তিনি মিনতিকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য বাইরের কোনও হাসপাতালে ‘রেফার’ করেননি? সুভাষবাবুকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “যা কিছু জানার সুপারের কাছে থেকেই জেনে নিন।”
সুপার রাঘবেশ মজুমদার অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁরা মিনতির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁর কথায়, “সময়ের অনেক আগেই বাচ্চাটি জন্মে গিয়েছে। তাই আমাদের কিছু করার ছিল না।” কিন্তু রোগিণী গর্ভবতী, তা জানতে পেরে তাঁর আলট্রাসনোগ্রাফি কিংবা প্রয়োজনীয় অন্যান্য চিকিৎসা কি করিয়েছিলেন তাঁরা? সুপার স্বীকার করে নিয়েছেন, তেমন কিছুই হয়নি।
তবে শুধু সন্তান প্রসবেই মিনতির ভোগান্তির শেষ হয়নি। এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্সে মিনতি ও তাঁর পুত্রসন্তানকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। অভিযোগ, শয্যা নেই জানিয়ে সেখান থেকে তাঁদের ফের পাভলভেই ফেরত পাঠানো হয়। ফলে মানসিক হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডের এক কোণে কার্যত বিনা পরিচর্যায় পড়ে রয়েছে ওই সদ্যোজাত।
কেন মা ও সদ্যোজাতকে ভর্তি নেওয়া হল না ন্যাশনালে? বিশেষত ওই হাসপাতালে যখন রুগ্ণ নবজাতকের জন্য বিশেষ কেন্দ্র (সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট) খোলা হয়েছে? ন্যাশনালের সুপার পার্থ প্রধান বলেন, “এটা কোনও ভাবেই হওয়ার কথা নয়। পাভলভ থেকে বহু রোগিণীকে আমরা ভর্তি করি। কেন এমন হল, তা বিশদে খোঁজ নিয়ে জানাব। তবে পাভলভের সুপার পাঠানোর সময়ে আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলে এই সমস্যা হয়তো হত না।” পাভলভের সুপার অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি নিজে একটি চিঠি লিখেই মা ও শিশুকে ন্যাশনালে পাঠিয়েছিলেন।
এর পরে কী হবে? সুপার কার্যত হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে জানান, “কী হবে, তা আমিও ঠিক জানি না। স্বাস্থ্য ভবনেও বিষয়টি জানিয়েছি।” মানসিক রোগের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি সেক্রেটারি শুভ মুখোপাধ্যায়কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে যা বলার উপ-স্বাস্থ্য অধিকর্তা তাপস নন্দী বলতে পারবেন।” তাপসবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হলে তাঁর বক্তব্য, “আমি বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানি না। এখন ছুটিতে রয়েছি।”
এই চাপান-উতোরের পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, কেন পাভলভের ওয়ার্ডে রাতে কোনও নার্স বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ডিউটিতে ছিলেন না? বদ্ধ ঘরে রোগিণীদের ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে সকলে চলে গেলেন কোন যুক্তিতে? কোনও রোগীর শরীর আচমকা বেশি খারাপ হলে বা অন্য কোনও ধরনের নিরাপত্তার সমস্যা ঘটলেও তো তাঁরা প্রয়োজনে ডেকেও কাউকে পাবেন না।
রোগিণীরা জানিয়েছেন, এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়। হাসপাতালের এটাই দস্তুর। হাসপাতালকর্মীদের একটা বড় অংশও মেনে নিয়েছেন, নার্সদের ডিউটি-রুম থাকলেও অধিকাংশ রাতেই সেখানে কেউ থাকেন না। কর্তৃপক্ষ সব জেনেও নীরব। তাই শুধু প্রসব নয়, রাতে কোনও রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা গেলেও দেখার কেউ থাকেন না। |