সম্পাদকীয় ১...
আপনি আচরি নীতি
নৈতিকতা তথা ন্যায়-অন্যায়ের তাত্ত্বিক আলোচনায় একটি প্রশ্ন বারংবার বড় আকারে দেখা দিয়াছে। একটি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হইবে কি না, তাহা কীসের উপর নির্ভর করে? নীতিশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারায় এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে জোর দেওয়া হইয়াছে সামাজিক নিয়ম এবং প্রতিষ্ঠানের উপর। বলা হইয়াছে, নিয়মাবলি যদি যথাযথ হয়, প্রতিষ্ঠানগুলি যদি উপযুক্ত হয়, তবে সমাজ ন্যায়সম্মত পথে চলিবে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান দর্শনবিদ জন রল্স-এর তত্ত্বে এই অভিমতের সমর্থন আছে। কিন্তু এই মতটির যাথার্থ্য লইয়া প্রশ্নও উঠিয়াছে। যেমন, অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তর্ক তুলিয়াছেন, সমাজে কেবল নিয়ম ও প্রতিষ্ঠান যথাযথ হইলেই ন্যায্যতার লক্ষ্য পূর্ণ হইবে, এমন ভরসার সঙ্গত কারণ নাই, সামাজিক মানুষ বাস্তবিক কী রূপ আচরণ করিতেছেন, তাহাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দর্শনশাস্ত্রের উচ্চমার্গে এই বিতর্ক কোন পথে চলিবে, তাহার কী মীমাংসা হইবে বা কোনও মীমাংসা হইবে কি না, তাহা পণ্ডিতদের বিচার্য। কিন্তু এই আলোচনা হইতে জনজীবনের উপর যে আলোকরেখা আসিয়া পড়ে তাহার মূল্য বিস্তর। যাঁহারা জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বা যাঁহাদের উপর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আরোপিত হয়, তাঁহাদের নৈতিকতা কি কেবল যথাযথ নিয়ম এবং প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিশ্চিত করা যাইতে পারে? তাঁহাদের ব্যক্তিগত সদাচরণই কি শেষ বিচারে সেই নৈতিকতার শর্ত নহে?
ভারতীয় রাজনীতি তথা প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি অতীতেও বহু বার উঠিয়াছে, এখনও উঠিতেছে। তবে গত কিছু কাল যাবত্‌ প্রশ্নটি এক নূতন মাত্রা এবং ব্যাপকতা অর্জন করিয়াছে। কী কেন্দ্রীয় তথা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে, কী রাজ্য স্তরে। কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক মন্ত্রী এবং আধিকারিকের আচরণ সম্পর্কে বড় আকারের অভিযোগ উঠিতেছে। আর্থিক দুর্নীতি হইতে শুরু করিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি নানা অভিযোগ। রাজ্যে অর্থ লগ্নি সংস্থার অন্যায় কারবারের সহিত বিভিন্ন ভাবে জড়িত থাকিবার এবং সেই সূত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করিবার অভিযোগে অভিযুক্ত হইতেছে প্রশাসন ও শাসক দলের বিভিন্ন স্তরের পদাধিকারীরা। তাঁহাদের বিরুদ্ধেও আর্থিক দুর্নীতি হইতে শুরু করিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি নানা অভিযোগ। আইনের দৃষ্টিতে এখনও সকল অভিযোগই অভিযোগমাত্র। কী কেন্দ্রে, কী রাজ্যে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে অভিযুক্ত কোনও এক জন ব্যক্তিও দোষী সাব্যস্ত হন নাই। কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নে? যাঁহারা অভিযুক্ত, তাঁহাদের আপনাপন পদে অধিষ্ঠিত থাকিবার নৈতিক অধিকার কি আছে?
এখানেই আইন, নিয়ম এবং প্রতিষ্ঠানের সীমা অতিক্রম করিয়া আচরণের গুরুত্ব। যতক্ষণ আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হইবে, ততক্ষণ অভিযুক্তরা সকলেই যে যাহার মন্ত্রিত্ব, সাংসদের আসন বা অন্য উচ্চপদে বেমালুম অধিষ্ঠান করিবেন ইহা আইন-সম্মত হইতে পারে, কিন্তু এমন আচরণকে নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা বলিয়া মানিয়া লওয়া কঠিন। যাঁহারা প্রশাসন বা আইনসভার সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত, তাঁহাদের নির্দোষ হওয়া যথেষ্ট নয়, জনসমাজে তাঁহাদের নিষ্কলঙ্ক ভাবমূর্তিও অত্যন্ত মূল্যবান। সেই ভাবমূর্তি রক্ষার দায় তাঁহাদের, এবং তাঁহাদের প্রশাসনিক বা দলীয় নেতৃত্বের। কী কেন্দ্রে, কী রাজ্যে, শাসক দলের নেতৃত্বও সেই নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হইয়াছেন। তাঁহাদের উচিত ছিল, ক্ষুদ্র স্বার্থের অঙ্ক না কষিয়া নৈতিকতার দাবিকে তাহার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গকে দ্রুত অপসারণ করা, অন্তত আপাতত। নিরপরাধ প্রমাণিত হইলে তাঁহাদের সসম্মান পুনর্বাসন নিশ্চয়ই সম্ভব। ভারতীয় রাজনীতিতে তেমন দৃষ্টান্ত বিরল হইলেও অভূতপূর্ব নহে। হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর নাম জড়িত হইলে তিনি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সরিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার সম্মানই বাড়িয়াছিল। নৈতিকতার সম্মান। সেই সম্মান আপন আচরণ দ্বারাই অর্জন করিতে হয়, আইন বা প্রতিষ্ঠানের ফাঁকফোকরের আড়ালে আশ্রয় লইয়া নিজেকে বা আশ্রিত তথা অনুগামীদের বাঁচাইবার চেষ্টা কেবল করুণ নহে, নিতান্ত অশোভন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.