সিবিআইয়ের হলফনামায় বিপাকে অশ্বিনী
রাজনীতির কবল থেকে যে তারা মুক্ত নয়, আজ সুপ্রিম কোর্টের সামনে সে কথা স্বীকার করে নিল সিবিআই।
শীর্ষ আদালতকে দেওয়া হলফনামায় সিবিআই প্রধান রঞ্জিত সিন্হার স্বীকারোক্তি, কয়লা কেলেঙ্কারির তদন্তের খসড়া রিপোর্ট শুধু যে আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় এবং কয়লা মন্ত্রকের কর্তাদের দেখানো হয়েছে, তা নয়। তাঁদের নির্দেশে সেই রিপোর্টে রদবদলও করা হয়েছে। বিরোধীদের পদত্যাগের দাবির মুখে আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার এত দিন বলে আসছিলেন, তিনি তদন্ত রিপোর্টে কোনও পরিবর্তন করতে বলেননি। আজ
সিবিআই প্রধান
রঞ্জিত সিন্হা
সিবিআইয়ের হলফনামা তাতে জল ঢেলে দিল। আর তার পরেই অশ্বিনীর পদত্যাগের দাবিতে নতুন করে সরব হয়েছে বিরোধীরা। তাদের বক্তব্য, অশ্বিনী এবং রেলমন্ত্রী পবন বনশল ইস্তফা না দিলে খাদ্য সুরক্ষা বিল (যে বিল হাতিয়ার করে দুর্নীতির প্রসঙ্গ থেকে নজর ঘোরাতে মরিয়া কংগ্রেস) পাশ করাতে দেওয়া হবে না।
তবে অশ্বিনী কুমার নন, কয়লা কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে সিবিআইয়ের হলফনামার জেরে বিরোধীদের নিশানায় এসে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও তাঁর সচিবালয়ও।
৯ পাতার হলফনামায় বলা হয়েছে, আইনমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের যুগ্মসচিব শত্রুঘ্ন সিংহ ও কয়লা মন্ত্রকের যুগ্মসচিব এ কে ভাল্লা তদন্ত রিপোর্ট থেকে তিনটি বিষয় বাদ দিতে এবং একটি বিষয় জুড়তে বলেন। বিরোধীদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া তাঁর দফতরের আমলার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব ছিল না।
তবে এই রদবদলের কথা বলেও সিবিআই যুক্তি দিয়েছে, এর ফলে তদন্ত রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্যে কোনও বদল হয়নি। কোনও অভিযুক্তের নাম বা প্রমাণও বাদ যায়নি। বিজেপি নেতৃত্বের পাল্টা যুক্তি, সিবিআই যতই বলুক মূল প্রতিপাদ্যে কোনও বদল হয়নি, কিন্তু আদতে সরকারের নির্দেশে তদন্তের মূল অভিমুখই ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া, ওই অন্তর্বর্তী রিপোর্টে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার কথা ছিল না। ফলে এই দাবিও অর্থহীন।
বিজেপি-র বক্তব্য, সিবিআই-কে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। তার তদন্তে নাক গলানো বেআইনি এবং অনৈতিকও বটে। বিশেষত যে সময় কয়লা খনি বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তখন ওই মন্ত্রক প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল। অর্থাৎ যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর দফতরই তদন্ত রিপোর্টে রদবদল করছে। আগামী বুধবার সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার পরবর্তী শুনানি। ওই দিন শীর্ষ আদালত সরকারের এই নাক গলানো নিয়ে কী অবস্থান নেয়, তার উপরে আইনমন্ত্রীর ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করছে। গত কাল কংগ্রেসের কোর গ্রুপের বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, আপাতত অশ্বিনী কুমার ও পবন বনশলের গদি যাচ্ছে না। কিন্তু সিবিআইয়ের হলফনামার পরে আজ কংগ্রেসের সূত্রেই ইঙ্গিত, ওটা কোনও পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে।
তবে অশ্বিনীকে সরানোটা দাবা খেলায় রাজার সামনে থেকে বোড়ে চলে যাওয়ার মতো। তাঁকে সরানো হলেই পুরো চাপটা প্রধানমন্ত্রীর উপরে এসে পড়বে। তাই আজও আইনমন্ত্রীর পক্ষেই সওয়াল করেছেন কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা। বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদের যুক্তি, “চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সুপ্রিম কোর্টই। কিন্তু আইনমন্ত্রী চোখ-কান বুজে বসে থাকবেন, তা-ও কি আশা করা যায়? পরিস্থিতির বিচারে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, তা তো তিনিই ঠিক করবেন।”
সংসদে ঢুকছেন অশ্বিনী কুমার। সোমবার।ছবি: পিটিআই
সুপ্রিম কোর্ট কি এই যুক্তি শুনবে? কয়লা কেলেঙ্কারিতে তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে সিবিআই-কে বন্ধ খামে হলফনামা পেশের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু তার আগেই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সেই রিপোর্ট দেখেন। সিবিআইয়ের আইনজীবী প্রথমে সে কথা অস্বীকার করলেও পরে তা মেনে নেন। এর জেরে গত সপ্তাহে সিবিআই-কে নজিরবিহীন ভাবে ভর্ৎসনা করে শীর্ষ আদালত বলে, এটা গভীর বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা।
সিবিআইয়ের কাছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান প্রশ্ন ছিল, কাকে কাকে তদন্ত রিপোর্ট দেখানো হয়েছে, কী কী পরিবর্তন হয়েছে এবং কার নির্দেশে হয়েছে? সিবিআই প্রধান আজ তাঁর হলফনামায় জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির শুরুতে প্রথম বার আইনমন্ত্রী নিজেই তাঁর চেম্বারে সিবিআই কর্তাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেলও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তখনও রিপোর্ট তৈরি হয়নি। এর পর ৬ মার্চ, সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট জমা দেওয়ার দু’দিন আগে আইনমন্ত্রী সেই রিপোর্ট দেখতে চান। সে দিন দুপুরে তাঁর দফতরে খসড়া রিপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়। আইনমন্ত্রীর নির্দেশে দু’টি ‘তাৎপর্যপূর্ণ বদল’ হয়েছে। দু’টি বদলই হয়েছে ২০০৬-২০০৯ সালের মধ্যে (অর্থাৎ ইউপিএ-১ আমলে) কয়লা ব্লক বণ্টন নিয়ে তদন্তের ক্ষেত্রে।
এর পর বিকেলে অ্যাটর্নি জেনারেল জি ই বাহানবতীর বাড়িতে রিপোর্ট নিয়ে বৈঠক হয়। তিনিও কিছু রদবদলের পরামর্শ দেন। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় ও কয়লা মন্ত্রকের যুগ্মসচিবরা সিবিআইয়ের যুগ্ম-নির্দেশকের দফতরে গিয়ে বৈঠক করেন। পরের দিন তাঁদের তরফেও কিছু রদবদলের পরামর্শ আসে।
সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন ছিল, সিবিআই গোড়ায় কেন বলেছিল রিপোর্ট কাউকে দেখানো হয়নি? রঞ্জিত সিন্হার দাবি, বিচারপতিদের প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল নিজে থেকেই এ কথা বলেছিলেন। সিবিআই তাঁকে এমন কোনও নির্দেশ দেয়নি। আইনমন্ত্রীর রিপোর্ট দেখার এক্তিয়ার আছে কি না, সেই প্রশ্নে সিন্হার জবাব, সংস্থার নির্দেশিকায় এ বিষয়ে কিছু বলা নেই।
বিজেপি মনে করছে, খুব সতর্ক ভাবে হলফনামাটি তৈরি করেছেন সিবিআই প্রধান। সত্যকে কিছুটা আড়াল করার চেষ্টা করলেও সরকার কী ভাবে তদন্তে হস্তক্ষেপ করেছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। আইনমন্ত্রী-সহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যে তিনটি বিষয় খসড়া রিপোর্ট থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি বলেন, প্রথমত, সরকার কয়লা খনি বণ্টনের জন্য যে কোনও মাপকাঠি নির্ধারণ করেনি এবং স্রেফ নিজেদের মর্জিমাফিক খনি বণ্টন করেছে, সিবিআই রিপোর্ট থেকে সেটাই বাদ দেওয়া হয়েছে। হলফনামা বলছে, প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় ও কয়লা মন্ত্রকের আমলাদের কথাতেই এটি বাদ গিয়েছে। অর্থাৎ সরকারি নীতিতেই যে দুর্নীতির বীজ ছিল, তা ধামাচাপা দিতে চেয়েছে সরকার।
দ্বিতীয়ত, কয়লা খনিগুলি কাকে দেওয়া হবে, কাকে হবে না, তার কোনও তালিকাও সরকার তৈরি করেনি বলে খসড়া রিপোর্টে লেখা হয়েছিল। আইনমন্ত্রীর কথায় এই তথ্যও বাদ গিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নীতির অসচ্ছতা ধামাচাপা দিতে চেয়েছে সরকার।
তৃতীয়ত, কয়লা খনি নিলাম করা হবে বলে যখন আইন তৈরি হচ্ছে, ঠিক তখনই সেগুলি বণ্টন করা হয়েছিল। খসড়া রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এটা কতটা আইনত, তা নিয়ে তদন্তের অবকাশ রয়েছে। আইনমন্ত্রী গোটা বাক্যটিই বাদ দিয়ে দেন। জেটলির মতে, ইউপিএ সরকার ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই ঘোষণা করেছিল, বাছাই কমিটির বদলে নিলাম করে কয়লা খনি বণ্টন হবে। অথচ সেই এই আইন হচ্ছে-হবে করে পাক্কা আট বছর কাটিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে যাবতীয় খনি বণ্টন করে দেওয়া হয়। কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এখানেই দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছিল।
তারা রিপোর্ট দিয়েছিল, এর ফলে সরকারের ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে কেলেঙ্কারির শিকড়, সেটাই সিবিআইয়ের রিপোর্ট থেকে বাদ দিয়েই সরকার তদন্তের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে।
এই তিনটি প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় ও কয়লা মন্ত্রকের আমলারা রিপোর্টে নতুন একটি লাইন যোগ করেন। যাতে বলা হয়, কয়লা খনি বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনও অনুমোদিত নির্দেশিকা ছিল না। অর্থাৎ, এটা বোঝানোর চেষ্টা যে নির্দেশিকা ভঙ্গ করে কিছু করা হয়নি। বিজেপির দাবি, এই সব রদবদলের জেরে তদন্তের মূল প্রতিপাদ্যই বদলে গিয়েছে।
সওয়াল-জবাব
মন্ত্রী-আমলাদের রিপোর্ট দেখানোর কথা জানাননি কেন?
রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য বদল হয়নি, সন্দেহভাজন বা অভিযুক্তের নাম বা তাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণ বাদ যায়নি। তাই জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি।

কেন কোর্টে বলা হয়েছিল রিপোর্ট কাউকে দেখানো হয়নি?
অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল কোর্টে নিজে থেকে এ কথা বলেন। সিবিআই কিন্তু তাঁকে এমন কিছু বলতে বলেনি।

মন্ত্রী-আমলাদের কথায় রিপোর্ট বদলেছে কি? কী বদল হয়েছে?
আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের যুগ্ম-সচিব ও কয়লা মন্ত্রকের আমলাদের কথায় তিনটি বিষয় বাদ গিয়েছে, একটি বিষয় যোগ হয়েছে।
সিবিআই-প্রধানের স্বীকারোক্তি
• তদন্তের খসড়া রিপোর্ট দেখতে চান আইনমন্ত্রী। তা দেখানো হয় এজি, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, কয়লা মন্ত্রকের কর্তাদেরও।
• কয়লা খনি বণ্টনের যে কোনও মাপকাঠি ঠিক করা হয়নি, সে কথা রিপোর্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়।
• খনি নিলাম করা হবে, এই আইন তৈরির কাজ চলার সময়ই খনি বণ্টন করা হয়। সিবিআই বলেছিল, এটা কতটা আইনত, তা তদন্ত করার অবকাশ রয়েছে। আইনমন্ত্রী এই গোটা বাক্যটিই বাদ দিয়ে দেন।
• তবে রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য বদল হয়নি। কোনও অভিযুক্তের নাম বা প্রমাণ বাদ যায়নি।

(সোমবারের হলফনামায় সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নের জবাবে সিবিআই)

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু
আইনমন্ত্রী তো চোখ-কান বুজে
বসে থাকতে পারেন না।
সলমন খুরশিদ, বিদেশমন্ত্রী
যিনি অভিযুক্ত (অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী), তাঁর
দফতরের কর্তাব্যক্তিরাই রিপোর্ট
দেখছেন, ইচ্ছেমতো পাল্টাচ্ছেনও।
অরুণ জেটলি, রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.