রোগটা নতুন নয়। ওষুধটাও পুরনো। কিন্তু দুইয়ের যোগসূত্রটা নতুন। আর এই যোগসূত্রই ভবিষ্যতে অব্যর্থ হয়ে উঠতে পারে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। পার্কিনসন্সের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ে এক ওষুধের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে বলে সম্প্রতি ‘জার্নাল অফ বায়োলজিক্যাল কেমিস্ট্রি’-তে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত শুধু ইঁদুরের উপরেই এই ওষুধ প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া গিয়েছে। চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, যতক্ষণ পর্যন্ত তা মানুষের উপরে প্রয়োগ করে সুফল না মিলছে, তত দিন এ ব্যাপারে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাবে না।
পারকিনসন্স ডিজিস। মহম্মদ আলির মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ বক্সারকেও কাবু করে ফেলতে পারে যে রোগ, তাকে কাবু করার পন্থার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করেছেন রুশ ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার-এর বিজ্ঞানীরা। ইঁদুরের উপরে দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে সফল হওয়ার ফলে পার্কিনসন্সের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ের দাবি করেছেন তাঁরা।
রুশ ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের অধ্যাপক ও গবেষক কালীপদ পাহান জানিয়েছেন, বুফিনাইল নামে একটি ওষুধ, যা মূলত দেহে ইউরিয়ার নিয়ন্ত্রণহীন বাড়া-কমা এবং রক্তের ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে, পারকিনসন্স রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও তা উল্লেখযোগ্য দিশা দেখাতে পারে।
পারকিনসন্স রোগটি কী? বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, এটি একটি স্নায়ুঘটিত অসুখ। মধ্য মস্তিষ্কের ‘সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা’ নামক অংশের স্নায়ু কোষগুলির মৃত্যু হলে সাধারণত এই রোগ হয়। স্নায়ুকোষগুলির মৃত্যু হওয়ার ফলে এর থেকে ‘ডোপামিন’ নামক প্রোটিন ক্ষরণ বন্ধ হয়। ‘ডোপামিন’-এর কাজই হল এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষে মস্তিষ্কের পাঠানো ‘সিগন্যাল’ নিয়ে যাওয়া। নতুন ওই গবেষণায় দাবি, সোডিয়াম ফিনাইলবিউটাইরেট বা বুফিনাইল স্নায়ুকোষগুলিকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায় এবং ডোপামিনের ক্ষরণও স্বাভাবিক রাখে।
কী ভাবে তা জানা গেল? কালীপদবাবুর দাবি, কিছু ইঁদুরকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত করে তাদের উপর বুফিনাইল প্রয়োগ করে দেখা গিয়েছে ইঁদুরগুলি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। এমনকী বাঁদরের উপরেও এই ওষুধটি প্রয়োগ করে বেশ ভাল ফল পাওয়া গিয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। পরবর্তী ধাপে মানুষের দেহে এই ওষুধ প্রয়োগে যদি সুফল পাওয়া যায়, তা হলে অসংখ্য পারকিনসন্স রোগীর কাছে তা নবজন্ম পাওয়ার সমতুল হবে বলে তাঁর আশা। কালীপদবাবু বলেন, “৭০ শতাংশের বেশি স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত।”
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় সাত লক্ষ মানুষ পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত এবং প্রতি বছরই প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। স্নায়ুরোগ চিকিৎসক শ্যামল দাস বলেন, “হাত-পায়ের কাঁপুনি, হাঁটা-চলার গতি অস্বাভাবিক ধীর হয়ে যাওয়া এই রোগের লক্ষণ। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগীদের হাতের লেখাও অদ্ভুত ভাবে ছোট হয়ে যায়, দেহের নমনীয়তা কমে যায়।” সাধারণত সুস্থ মানুষের হাঁটা-চলার সময়ে হাত ও পা সমান তালে আগুপিছু করে। কিন্তু পারকিনসনস রোগীদের ক্ষেত্রে হাঁটার সময়ে পায়ের সঙ্গে সমানতালে হাত এগোয় না। শ্যামলবাবু বলেন, “এ ক্ষেত্রে হাত খুবই আস্তে চলাচল করে। এঁদের সামনের দিকে অল্প ঠেলা দিলেই গড়গড় করে সামনে এগিয়ে চলেন, ঠিক তেমনই পিছনের দিকে অল্প ঠেলা দিলেও গড়গড় করে পিছনে চলতে শুরু করেন।”
এমন একটি জটিল রোগের নতুন ওষুধের সন্ধান মেলার এই সম্ভাবনায় খুশি স্নায়ুরোগ চিকিৎসকেরাও। স্নায়ুরোগ চিকিৎসক তৃষিত রায় বলেন, “এই রোগ নিরাময়ের কোনও ওষুধ নেই। তবে এমন অনেক ওষুধ আছে, যা দিয়ে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সেই তালিকায় যদি নতুন কিছুর সংযোজন হয়, তা হলে তা খুবই আশাপ্রদ।” একই অভিমত আর এক স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়েরও। তাঁর কথায়, “মানুষের দেহে এর প্রয়োগ যদি সফল হয়, তা হলে তা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।” |