বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা যতটা জরুরি, ঠিক তেমনই রোগ লুকিয়ে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ঠেকানোটাও ততটাই জরুরি। চিকিৎসকদের এই পরামর্শ সহজে কানে তোলেন না বেশিরভাগ মানুষই। এ বার এই বার্তা নিয়ে চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন খোদ এক রোগিণী। রোগের কথা লুকিয়ে যাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ বাবা-মা। এমনকী, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মেয়ের লেখাপড়া শেষ করার দিকেও গুরুত্ব দেননি তাঁরা। যার জেরে জীবনের প্রতি পদক্ষেপে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে সেই মেয়েকে। তবু লড়াইটা থামেনি। এই গোটা লড়াইটাই ধরা পড়েছে এক তথ্যচিত্রে, যার নাম “নদীর নাম দেবযানী”। বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস উপলক্ষে অচিরেই এই তথ্যচিত্রটি আলোর মুখ দেখতে চলেছে। চিকিৎসক মহলের আশা, নিছক মুখের কথায় যে কাজ তাঁরা
|
দেবযানী ঘোষ |
করতে পারেন না, দেবযানীর জীবন-কাহিনী সেই সচেতনতা গড়ার কাজটা অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাবে।
দেবযানী ঘোষের বয়স এখন ৫০ পেরিয়েছে। সফল ব্যবসায়ী এই মহিলার পরিচিতি রয়েছে বিভিন্ন মহলেই। কিন্তু দেবযানী নিজে জানিয়েছেন, তাঁর জীবনটা এত দূর গড়ানোর কথাই ছিল না। জন্ম থেকেই রুগ্ন ছিলেন তিনি। জ্বর, বমি, পেটের অসুখ লেগেই থাকত। তাঁর পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বাবা-মা জানতে পারেন, মেয়ে বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগী। আর সেই সত্যটা তিনি নিজে জানতে পারেন তাঁর ৩০ বছর বয়সে। দেবযানীর কথায়, “ততদিনে অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। এখন যখন শুনি ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগীদের তিন-চার বছর বয়স থেকে রক্ত দেওয়া দরকার, তখন আমার ভেতরটা জ্বলে ওঠে। সমাজের কাছে আমার রোগটা লুকিয়ে রাখার জন্য আমাকে যথাযথ চিকিৎসার সুযোগটা দেননি আমার পরিবারের লোকেরা। অথচ আমার বাবা নামী স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক ছিলেন।”
এরই মধ্যে ১৯ বছর বয়সে রোগ লুকিয়ে তাঁর বিয়ে ঠিক করেন বাবা-মা। দেবযানী বলেন, “এই রোগ নিয়ে বাঁচছি, আমাকে জীবনে অনেক বাধার মুখোমুখি হতে হবে, এটা তো জানতেন আমার বাবা-মা। তবু তাঁরা আমাকে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর করার কোনও চেষ্টা না করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন হয়। তাই আমার মনে হল, আমি যদি এগিয়ে এসে এগুলো না বলি, তা হলে বহু মেয়ের জীবনটা ভেসে যেতে পারে। সবার তো সমান মনের জোর থাকে না।”
পরপর দু’বার মা হতে গিয়ে ব্যর্থ হন দেবযানী। প্রথম বার হিমোগ্লোবিন কমে যায় অনেকটাই। আর পরের সন্তানটি জন্মের দু’ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। দেবযানীর কথায়, “সকলে ধরেই নিয়েছিলেন, আমি কখনও মা হতে পারব না। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি।” বহু চেষ্টার পরে একটি সুস্থ পুত্রসন্তানের জন্ম দেন দেবযানী। আর তার পরে শুরু হয় এই রোগে সচেতনতা তৈরির ব্যাপারে তাঁর লড়াই।
হেমাটোলজিস্ট উৎপল চৌধুরী বলেন, “বাবা-মা দু’জনে থ্যালাসেমিয়া কেরিয়ার হলে সন্তান কেরিয়ার হতে পারে, আবার স্বাভাবিকও হতে পারে। কিন্তু বাবা-মায়ের মধ্যে এক জন রোগী, অন্য জন স্বাভাবিক হলে সন্তান কেরিয়ার হবে। কেরিয়ার হলে
সাধারণ ভাবে কোনও সমস্যা থাকার কথা নয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।”
বিভিন্ন কল-কারখানায় শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য চামড়ার পোশাক ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে দেবযানীর সংস্থা। ব্যবসার কাজে বাড়ি থেকে অনেক দূরে যেতে হয় তাঁকে। তাঁর চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বাসে-ট্রেনে একটানা যাতায়াতের ধকল সহ্য হয় না বেশিরভাগ সময়েই। তখন মাঝপথে নেমে স্টেশনে বা বাস স্টপে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফের যাত্রা শুরু। বছর পাঁচেক আগেও সপ্তাহে তিন বার রক্ত নিতে হত তাঁকে। দেহে আয়রন জমা হয়ে প্লীহাটা অস্বাভাবিক বড় হয়ে গিয়েছিল। এতটাই বড় যে সালওয়ার কামিজ পরতে পারতেন না। সোজা হয়ে হাঁটতেও পারতেন না। চিকিৎসকের পরামর্শে পাঁচ বছর আগে অস্ত্রোপচার করে প্লীহাটা বাদ গিতে হয়েছিল। তার পর থেকে রক্ত নিতে লাগেনি, ওষুধের মাধ্যমেই চিকিৎসা চলছে। দেবযানী বললেন, “কিন্তু আবার হিমোগ্লোবিন কমছে। বুঝতে পারছি ফের শরীরটা খারাপ হবে। কিন্তু তাতে লড়াইটা থামবে না।”
দেবযানীর এই ‘স্পিরিট’টাই বাকিদের সামনে তুলে ধরতে চান চিকিৎসকেরা। তাঁর জীবন নিয়ে এই তথ্যচিত্রটি প্রযোজনা করছে মধ্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতাল। পরিচালক অরিন্দম সাহা সর্দার। ওই হাসপাতালের অধিকর্তা, হেমাটোলজিস্ট আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “থ্যালাসেমিয়া রোগীরাও যে আর পাঁচ জনের মতো স্বাভাবিক সামাজিক ও পারিবারিক জীবন কাটাতে পারেন, সেই বার্তাটাই আমরা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। রোগ লুকোনোর দরকার নেই। সঠিক চিকিৎসা আর হার না
মানা মনোভাবটা জরুরি। দেবযানী তারই উদাহরণ।” |