গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্কের বরফ গলার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের পাহাড়ে যেতে পারেন আর দিন দশেকের মধ্যেই। তার মুখেই রবিবার মিরিকে জিএনএলএফের একটি সভাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় গোলমালের পরে মোর্চা-র সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের সিদ্ধান্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠল পাহাড়। মমতা-মোর্চা সম্পর্কও এই ঘটনায় কিছুটা হলেও ধাক্কা খেল।
সুবাস ঘিসিংয়ের দলের ওই ঘরোয়া সভার পরে জিএনএলএফ কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে এই দিন মোর্চার সদস্যদের মারপিটে প্রথমে তেতে ওঠে মিরিকের সৈরিনি এলাকা। দু’পক্ষের ১১ জন জখম হন। পুলিশ জিএনএলএফের ৩ জনকে গ্রেফতার করে পরিস্থিতি আয়ত্তেও আনে। কিন্তু সকাল থেকেই ওই এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে বসে-থাকা গুরুঙ্গ মিরিকের ওসি সৌরভ সেনের বদলির দাবিতে হঠাৎই পাহাড়ে অনির্দিষ্ট কালের বনধ ডেকে দেন। ভরা পর্যটন মরসুমে পর্যটকদের চরম ভোগান্তির আশঙ্কায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী কড়া ভাষায় পাহাড়ে অশান্তি বরদাস্ত করবেন না বলে জানিয়ে দিলে কিছুটা সুর নরম করে আপাতত বনধ প্রত্যাহার করে নেন গুরুঙ্গ। তবে তার পরেও তাঁর হুঁশিয়ারি, “সোমবার সনধ্যা ৬টার মধ্যে মিরিকের ওসি-কে না সরালে পাহাড়ে অনির্দিষ্ট কালের বনধ
শুরু হবে।” |
শুধু তাই নয়, মিরিকের ঘটনার পরে দার্জিলিং, জোড়বাংলো ও কার্শিয়াঙের চিলুনিধুরায় তিন জিএনএলএফ নেতার ঘরদোর ভাঙচুর করা হয়েছে। দার্জিলিঙের জিএনএলএফ নেতার বাড়িতে হামলার পরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গাড়িধুরায় পুলিশ ফাঁড়ি ভাঙচুর হয়। বাধা দিতে গেলে এক হামলাকারী এক পুলিশ অফিসারের কলার টেনে ধরেন ফলে পরিস্থিতি ফের তেতে ওঠে। সব ঘটনা মিলিয়ে পুলিশ ২০ জন মোর্চা সমর্থককে গ্রেফতার করেছে। জিএনএলএফের ৬ জন গ্রেফতার হয়েছেন। রাতে গোটা দার্জিলিঙে পুলিশি টহলদারি বাড়ানো হয়েছে। সিআরপি-র একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয়েছে পাহাড়ে। ঘটনাচক্রে, সিআরপি-র আর এক কোম্পানি এদিনই জঙ্গলমহলে ফিরে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের তরফে এক কোম্পানি সিআরপি ফিরিয়ে আনার দাবি উঠেছে। দার্জিলিংয়ের পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, “পুলিশই পরিস্থিতি আয়ত্তে এনেছে। তবুও ওসি-র বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে তা লিখিত দিতে বলেছি। তা পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।” মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “মিরিকের ওসি-র ভূমিকায় আমরা সন্তুষ্ট নই। ওঁকে সরিয়ে ঘটনার তদন্ত হোক।
মোর্চা এই দিন ফের মুখ্যমন্ত্রীর ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ মেজাজের আঁচ পেয়েছে। মমতা বলেন, “একটা স্থানীয় গোলমালের জেরে গোটা পাহাড়কে অশান্ত করার চেষ্টা কিছুতেই বরদাস্ত করব না। কোনও বেআইনি কাজ হয়ে থাকলে পুলিশ-প্রশাসন দেখবে। কেউ আইন নিজের হাতে নিতে পারে না।” তাঁর বক্তব্য, “কোথাও মারপিট, ভাঙচুর, আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটলে পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখতে পারে না। আইনত যা করণীয় তা পুলিশ করবে। মোর্চা নেতাদের সে কথা জানিয়ে দিয়েছি। এটাও বলে দিয়েছি, বনধ, হিংসার রাস্তায় হাঁটা যাবে না। তা হলে আমাকে পাশে পাওয়া যাবে না।” পাশাপাশি, পর্যটন মরসুমে দার্জিলিঙে গিয়ে যাতে এক জন পর্যটকও অসুবিধেয় না-পড়েন তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিন দিন আগেই মহাকরণে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে পাহাড়ে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মোর্চা নেতারা। সরকারি ভাবে ঠিক হয়েছে, আগামী ১৩ মে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিঙে গিয়ে জিটিএ-এর নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন। পর দিনই মুখ্যমন্ত্রীর পাহাড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। জিটিএ চিফ গুরুঙ্গের তরফে সরকারি ভাবে দু’এক দিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লিখিত আমন্ত্রণ পৌঁছনোর কথা। তার মুখে স্থানীয় একটি গোলমালের ঘটনার জেরে পরিস্থিতি এতটা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল কেন?
পাহাড়ে রাজনীতিকদের একাংশের অনুমান, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এই দিন আক্রান্ত হওয়ার পরে জিএনএলএফ কর্মী সমর্থকেরাও পাল্টা আক্রমণ করেছেন। তাতে মোর্চার মিরিকের কাউন্সিলর অরুণ সিংহ সহ ৩ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের ধারণা, পাহাড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উপরে রাজ্য সরকার জোর দেওয়ার পর থেকে জিএনএলএফের প্রভাব বেড়েছে। ঘিসিং নিজে জলপাইগুড়ি ছেড়ে জিটিএ এলাকায় মাটিগাড়ায় থাকতে শুরু করেছেন। সিআরপি-র ভরসায় তাঁরা পাহাড়ে সভাও করছেন। তাতে ভিড়ও হচ্ছে। তাতে উদ্বিগ্ন মোর্চা নেতৃত্ব। সেই উদ্বেগই এই দিন মিরিকের সভার পরে প্রকট হয়ে গিয়েছে বলে জিএনএলএফ নেতাদের দাবি।
তাঁরা জানিয়েছেন, বিনা প্ররোচনাতেই এই দিন তাঁদের কর্মী সমর্থকদের মারধর করা হয়েছে। জিএনএলএফ নেতা মহেন্দ্র ছেত্রী বলেন, “ওরা ভয় পেয়ে রয়েছে। তাই আমাদের ভয় পাওয়াতে চাইছে।” মিরিক দু’পক্ষের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণও। কেননা, মিরিক থেকেই ঘিসিংয়ের উত্থান শুরু হয়। পাহাড়ের ব্যবসায়ী মহলেরও বক্তব্য, জিএনএলএফ আবার প্রভাব বাড়াতে শুরু করাতেই খেপে উঠেছে মোর্চা। কিন্তু গণ্ডগোলের জেরে যদি ব্যবসা মার খায়, মানুষের রুটি-রুজিতে টান পড়ে তা হলে আরও বেশি করে মানুষ জিএনএলএফের দিকে ঝুঁকবে।
এই ঘটনার পরে মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা অবশ্য স্বীকার করেন, দলের কর্মীদের উপরে আগের মতো নেতাদের নিয়ন্ত্রণ না-থাকায় নানা এলাকায় মর্জিমাফিক কাজ হচ্ছে। মোর্চার রোশন গিরি বলেন, “আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠছে, তা ঠিক নয়। তবুও আমরা দলের তরফে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।”
ফের পাহাড় অশান্ত হয়ে ওঠায় শঙ্কিত মোর্চা বিরোধী দলগুলিও। প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “মোর্চা এখন জিটিএ চালাচ্ছে। কোনও বেআইনি কাজ হলে আইনি ব্যবস্থা নেবে। তা বলে আইন নিজের হাতে নেওয়া ঠিক নয়। পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখতে হবে। সব দল যাতে সভা-সমাবেশ করতে পারে মোর্চাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।” গোর্খা লিগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ খাতি জানান, পর্যটন মরসুমে এমন বনধের হুমকি দেওয়ায় পাহাড়ের অর্থনীতির ক্ষতি হবে। সিপিআরএমের নেতা রত্নবাহাদুর রাই জিএনএলএফ-মোর্চা দু’পক্ষকেই সমালোচনা করেছেন। তাঁর অভিযোগ, “ঘিসিং আড়াই দশক শাসনে থেকেও পাহাড়ের উন্নয়ন করেননি। এখন মোর্চাও সে পথে হাঁটছে। দু’পক্ষ গোলমাল বাঁধিয়ে পাহাড়কে অনধকার যুগে নিয়ে যেতে চাইছে।” কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথ ভাবে চেষ্টা না-করলে পাহাড়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরবে না বলে তাঁর ধারণা।
আশঙ্কিত পর্যটন ব্যবসায়ীরাও। ট্যুর অপারেটর সম্রাট সান্যাল বলেন, “আশা করি বনধ প্রত্যাহৃত হবে। তবে আচমকা বনধ ডাকার এই প্রবণতা ছাড়তে হবে।” |