“স্কুলে এসেছ কেন, পড়াশোনা নেই” শিক্ষকের এই কথা শুনে চমকে উঠেছিল একাদশ শ্রেণির ছাত্রীটি। জবাব খুঁজে পায়নি সে।
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, রাজ্য জুড়েই একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-নির্ভরতা কমছে। কোথাও শিক্ষকই ছাত্রদের স্কুলে আসতে মানা করছেন, কোথাও আবার নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে এসেও দু’-তিন জনের বেশি ছাত্রের দেখা পাচ্ছেন না শিক্ষক। বিজ্ঞান শাখার পড়ুয়ারা প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস না থাকলে স্কুলে যায় না। কলা ও বাণিজ্যের ছাত্রছাত্রীরাও স্কুলের ক্লাসকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। সমস্যা অজানা নয় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের।
সংসদ সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “উচ্চ মাধ্যমিকে, বিশেষ করে একাদশ শ্রেণিতে ক্লাস যে হয় না, তা আমরা জানি। আইন করে তো ছাত্র বা শিক্ষকদের ক্লাসমুখী করা যায় না।”
উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে পড়ানো হবে না কলেজে, তা নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। বছর দশেক আগে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি স্কুলে পড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এতে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের অনুশাসনে রাখা যাবে বলে মনে করা হয়েছিল। বাস্তবে কিন্তু তা হচ্ছে না। কলকাতার নামী সরকারি স্কুলের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার ছাত্র গগন রায়ের কথায়, “প্র্যাক্টিক্যাল না থাকলে জনা চারেক ছেলে আসে। ওই দিনগুলোয় শিক্ষকেরাও ক্লাসে আসেন না।” মফস্সলেও এক ছবি। কিন্তু কলা-বাণিজ্য বিভাগে স্কুল নির্ভরতা কমছে কেন? শিক্ষক-অভিভাবকদের মতে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এখন জ্ঞানার্জন নয়, চাই নির্দিষ্ট পদ্ধতি ধরে পড়াশোনা। সেটা যেখানে সহজে মিলবে, ছেলেমেয়েরা সেখানেই যাবে।
আর এখানেই বাড়ছে প্রাইভেট টিউশনের রমরমা। মাধ্যমিক মিটতেই অভিভাবকেরা ভাল গৃহশিক্ষকের খোঁজ করছেন। শহরতলি ও গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা তো দীর্ঘ পথ উজিয়ে টিউশনে যাচ্ছে। আর সে ক্ষেত্রে স্কুল কামাইয়ে কসুর করছে না তারা। এক শ্রেণির শিক্ষকও স্কুলের ক্লাসকে গুরুত্বহীন করে মেতে রয়েছেন টিউশন নিয়ে। খাস কলকাতা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম, সর্বত্রই এমন শিক্ষকের দাপট। নিয়ম-নির্দেশিকা করেও এই প্রবণতা বন্ধ করা যায়নি।
অন্য দিকে, উচ্চশিক্ষিত বহু যুবক-যুবতী এখন গৃহশিক্ষকতাকে পেশা করেছেন। দরিদ্র বাড়ির ছেলেমেয়েরাও সেখানে ভিড় করছে। আজিমগঞ্জের একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের ছাত্রী সালেমা খাতুন বলে, “বাবার চা দোকান। কষ্ট করেই গৃহশিক্ষকের টাকা দেন। উপায়ও নেই। স্কুলে তো আর সব পড়ায় না।” স্কুলের ভরসায় থাকতে পারেননি বলেই ছেলেকে টিউশনে পাঠাতেন হুগলির ভ্যানচালক সঞ্জয় মণ্ডল। তাঁর ছেলে বিজয় এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। সঞ্জয়বাবুর কথায়, “ক’টাকা আর আয়। তা-ও ছেলের টিউশনের পিছনে মাসে ছ’শো টাকা করে গুনেছি। পাশ তো করতে হবে।”
অর্থাৎ শুধু স্কুলের ভরসায় উচ্চ মাধ্যমিক উতরোনো যাবে না এটাই সর্বজনীন বিশ্বাস। অথচ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য সরকারের ব্যয় বিপুল। প্রতি বছর একাধিক স্কুল উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত হচ্ছে। পরিকাঠামো থেকে শিক্ষক নিয়োগ, নানা খাতে ব্যয় বাড়ছে। শিক্ষকদের বেতন বাবদও যথেষ্ট ব্যয় হয়। যাঁরা এখন চাকরিতে ঢুকছেন, তাঁদের বেতনক্রম মাসে ২৪ হাজার টাকা। আর যাঁরা এই সময় অবসর নিচ্ছেন, তাঁদের বেতনক্রম প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। শিক্ষকদের জন্য এই বিপুল ব্যয় করেও ছাত্র স্বার্থে তাঁদের ব্যবহার করা যাচ্ছে না। শাসকদলের শিক্ষক সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি’র রাজ্য সম্পাদক দিব্যেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতে, “এক শ্রেণির আদর্শচ্যুত শিক্ষক টিউশন-রাজ চালাচ্ছেন। ছেলেমেয়েরাও বই পড়ে বিষয় বুঝতে আগ্রহী নয়। নোট পেলেই হল। অনেকে আবার নেট থেকে সব ডাউনলোড করে নিচ্ছে।”
আর একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন বহরমপুরের কাশিমবাজার মহাজন সমিতি হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক কাঞ্চন ভাদুড়ি। তাঁর মতে, “বিজ্ঞানের প্রায় সব ছাত্রছাত্রীর লক্ষ্য জয়েন্ট। অথচ একাদশ-দ্বাদশের সিলেবাস জয়েন্ট অনুসারী নয়। টিউশন নির্ভরতার এটাও কারণ।” পাণ্ডুয়া শশীভূষণ সাহা হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের মতে আবার, “একাদশ শ্রেণির নম্বর উচ্চ মাধ্যমিকে গুরুত্ব না পাওয়ায় এই ক্লাসটাকে কেউ গুরুত্বই দিচ্ছে না।” অথচ নিয়মমতো ৭০ শতাংশ হাজিরা না থাকলে বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার কথা নয়। শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, নিয়ম রয়েছে নামেই। যেখানে অনুত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের বোর্ডের পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন হয়, সেখানে অনুপস্থিতির কারণে ক্লাসে না তুললে শিক্ষকদের ঘাড়ে মাথা থাকবে না।
পরিস্থিতিতে রাশ টানতে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে সরকার। ছাত্রদের বিদ্যালয়মুখী করতে ‘ওরিয়েন্টেশন ক্যাম্প’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী জুন থেকে অত্যাধুনিক হচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসও। সংসদ সভাপতি আরও বলেন, “উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্টে যাতে একাদশ শ্রেণির নম্বরের একটা প্রতিফলন রাখা যায় সেই চেষ্টা করছি। এতে ক্লাস করার চাপ তৈরি হবে।” একই সঙ্গে তাঁর স্বীকারোক্তি, “চাপ দিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনতে হচ্ছে, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।” |