শাসক দল আগেই তাঁকে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছে। এ বার আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রশাসনিক সাঁড়াশির মুখে সিপিএমের দাপুটে নেতা গৌতম দেব। বাম জমানায় গৌতমবাবুর আবাসন দফতরের কার্যকলাপ নিয়ে সিআইডি তদন্ত শুরু করেছে রাজ্য সরকার।
গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বাম জমানায় তাঁর আবাসন দফতর বিনা টেন্ডারে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিল মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি সংস্থাকে। যার জেরে আবাসন দফতরের ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি টাকারও বেশি। অভিযোগ, ওই সংস্থাটির সঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ছেলে চন্দন বসুর নাম জড়িত। গত মাসেই আবাসন দফতরের সচিবের পক্ষ থেকে গৌতমবাবু-সহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে পুলিশে এফআইআর করা হয়। তার পরেই সরকারের তরফে ওই দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়েছে রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডি-র হাতে। আবাসন দফতরের ওই অভিযোগের তদন্তের জন্য সিআইডি-র একটি বিশেষ দলও গঠন করা হয়েছে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন এক জন ডেপুটি সুপার (ডিএসপি)। সিআইডি-র স্পেশ্যাল আইজি বিনীত গোয়েল অবশ্য বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে। এখন কিছু বলা যাবে না।”
মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে সিপিএমের রাজ্য নেতাদের মধ্যে সব চেয়ে সরব এবং আক্রমণাত্মক গৌতমবাবুই। তাই তাঁকে আবার পাল্টা আক্রমণের নিশানা করেছে শাসক দল। আগেও প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে বারেবারেই দুর্নীতির অভিযোগ করেছে তৃণমূল। শাসক দল এবং স্বয়ং তৃণমূল নেত্রীর পরিবারকে জড়িয়ে দুর্নীতির অভিযোগ করায় গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও হয়েছে। কয়েক দিন আগেই প্রাক্তন মন্ত্রীর পরিবারকে আবার পাল্টা জড়িয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস। কিন্তু সরাসরি পুলিশে অভিযোগ এবং তার ভিত্তিতে বাম জমানার এক প্রভাবশালী প্রাক্তন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সিআইডি তদন্ত এই প্রথম।
গৌতমবাবু অবশ্য এই পদক্ষেপে বিচলিত নন। মমতা তাঁর পিছনে পুলিশ লাগিয়ে কিছু করতে পারবেন না, হামেশাই বলে থাকেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এই সদস্য। মন্ত্রী হিসেবে তাঁর পুরনো দফতরের কাজ নিয়ে সিআইডি তদন্তের সিদ্ধান্ত জেনেও রবিবার গৌতমবাবু বলেছেন, “আমি স্বাগত জানাচ্ছি! সিআইডি কেন, তৃণমূলের প্রথম সারির তিন জন নেতা-মন্ত্রীকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গড়ে দিন মুখ্যমন্ত্রী। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রাক্তন মুখ্যসচিব এবং এখন মন্ত্রী মণীশ গুপ্তকে রাখুন। সেই কমিটি তদন্ত করুক। তারা বলুক আমি বেআইনি কাজ করেছি!” গৌতমবাবুর যুক্তি, রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করালে কিছু নিয়ম মানতে হবে, ন্যূনতম কিছু নিরপেক্ষতা দেখাতে হবে। তার বদলে তৃণমূলের দলীয় তদন্ত কমিটিও যদি হয়, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত!
সিপিএম নেতৃত্বর মতে, রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে তৃণমূল ‘প্রতিহিংসা’র পথে যাচ্ছে। দলের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “ওঁরা চাইছেন যে করে হোক গৌতমবাবুর মুখ বন্ধ করতে! কিন্তু এ ভাবে কিছু করতে পারবেন না। শুধু গৌতমবাবু কেন, আমরা সবাই জেলে যেতে তৈরি আছি!” চন্দনবাবুর নাম জড়ালেও তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি।
সিআইডি সূত্রের খবর, আবাসন দফতরের সচিবের দায়ের-করা অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালে ওই সংস্থাটিকে বিনা টেন্ডারে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে বাড়ি বানানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল আবাসন দফতরের পক্ষ থেকে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার দু’টি জায়গায় নিম্ন, মধ্য ও উচ্চবিত্তদের জন্য বাড়ি তৈরি করার কথা ছিল প্রাক্তন মন্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ ওই সংস্থার। অভিযোগ, সংস্থাটি উচ্চবিত্তদের জন্য কিছু বাড়ি তৈরি করলেও নিম্ন এবং মধ্যবিত্তদের জন্য কিছু করেনি। আবাসন দফতরের অভিযোগ, নিজেরা বাড়ি তৈরি না করে ওই সংস্থা আবার অন্য একটি সংস্থাকে বাড়ি তৈরি করার জন্য ‘লিজ’ দিয়ে দেয়। কিন্তু ওই সংস্থাও শেষ পর্যন্ত কোনও আবাসন গড়েনি বলেই সরকারি পক্ষের অভিযোগ।
সিআইডি সূত্রেরই বক্তব্য, আবাসন দফতরের সঙ্গে প্রাক্তন মন্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ সংস্থাটির সমঝোতা হয়েছিল যে, নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি তৈরি না-হলে জরিমানা-সহ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু ঠিক সময়ে অভিযুক্ত সংস্থাটি বাড়ি তৈরি করেনি। কোনও জরিমানা বা ক্ষতিপূরণও দেয়নি। আবাসন দফতরের এক অফিসারের দাবি, এতে প্রায় ১১ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে দফতরের। এবং বিনা টেন্ডারে ওই সংস্থাকে জমি দেওয়ায় দফতরের ক্ষতি হয়েছে ১৯ কোটি টাকার কিছু বেশি। |