সোয়াই মান সিংহ স্টেডিয়ামে ম্যাচটা শেষ হওয়ার পর দেখছিলাম গ্যালারির দিকে মুখ করে রাহুল দ্রাবিড় হাততালি দিচ্ছে। জয়পুরের গ্যালারিও পাল্টা সেলাম ঠুকছে ওকে। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে মনের ভিতর অদ্ভুত একটা ভাললাগা যেমন তৈরি হচ্ছিল, তেমনই একটা কথা ভেবে দুঃখও হচ্ছিল।
ভারতীয় ক্রিকেটের দুর্ভাগ্য অধিনায়ক দ্রাবিড়কে তারা পেল না। দুর্ভাগ্য অধিনায়ক দ্রাবিড়কে চিনতে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত আইপিএলে এসে। ওর চল্লিশ বছর বয়সে।
সব অধিনায়ক আগ্রাসী হবে, দুঁদে হবে, টিম তার কথায় ওঠ-বস করবে, এমন কোনও মানে নেই। সবাই এক রকম হয় না। কেউ সেট টিম পেতে ভালবাসে। কেউ টিম তৈরি করতে ভালবাসে। বিশ্বফুটবলে মোরিনহো আর স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন যেমন। মোরিনহো পছন্দ করেন মহাতারকাদের নিয়ে তৈরি একটা সেট টিম চালাতে। স্যর অ্যালেক্স আবার ভালবাসেন প্লেয়ার তুলে আনতে। তাদের তৈরি করতে। আমার কাছে, দ্রাবিড় দ্বিতীয় ঘরনার।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি বিশ্বাস করি, একটা টিম তৈরি করতে যে সময়টা দরকার পড়ে, সেটা দ্রাবিড়কে দেওয়া হয়নি। এক-একটা ম্যাচ হারলেই ‘গেল গেল’ চিৎকার উঠেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে বিপর্যয়ের পর প্রথম আওয়াজ উঠেছে, ক্যাপ্টেন্সি থেকে দ্রাবিড়কে সরাও। আজ দেখুন, দ্রাবিড় ক্যাপ্টেন হিসেবে কেমন ছিল। আমি তো বলব, পেপসি আইপিএলটা দ্রাবিড়ের জন্যই শুধু মনে রাখা যায়। তা সে শেষ পর্যন্ত রাজস্থান রয়্যালস চ্যাম্পিয়ন হোক চাই না হোক। |
যুবরাজের ব্যর্থতার সিরিয়াল থামছে না। ছবি: পিটিআই |
রাজস্থান টিমকে কী ভাবে চালাচ্ছে দ্রাবিড়, তা নিয়ে একটু পরে আসছি। ওর ব্যক্তিগত ফর্মের কথা আগে বলতে চাই। এক কথায়, মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি দ্রাবিড়কে দেখে। চল্লিশ বছরে এই ফিটনেস, এই ফর্ম, স্রেফ ভাবা যায় না! সচিন তেন্ডুলকর বা রিকি পন্টিংদের সঙ্গে আমি দ্রাবিড়ের তুলনায় যাচ্ছি না। একটা আইপিএল দিয়ে সচিন-পন্টিংদের বিচার করা ঠিক হবে না। কিন্তু দ্রাবিড়ের প্লাস পয়েন্ট হয়ে যাচ্ছে ওর শারীরিক গঠন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরেও ও শরীরে এতটুকু মেদ জমতে দেয়নি। আমি নিজের চোখে দেখেছি, দ্রাবিড় কী রকম ফিটনেস নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে। দেখেছি, এনসিএ-তে ভোর ছ’টায় ঢুকে বিকেল ছ’টায় বেরোতে। কোনও সন্দেহ নেই, এ বার আইপিএলে নামার আগে নিজেকে চূড়ান্ত ফিট রাখার অক্লান্ত চেষ্টা করেছে দ্রাবিড়। ক্লাস ওর বরাবরের। আর তার সঙ্গে ফিটনেস যোগ হওয়াতে এই চল্লিশেও ওকে থামাতে বিপক্ষের কালঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে। রবিবার যেমন পুণে ওয়ারির্সের বিরুদ্ধে ৪০ বলে ৫৮ করে গেল!
কয়েকটা ছোট ছোট ব্যাপার দ্রাবিড় টিমে এনেছে, যে কারণে আরও চার্জর্ড হয়ে যাচ্ছে রাজস্থান। এ দিন দেখছিলাম, বিরতিতে ড্রেসিংরুমে ঢোকার সময় প্রত্যেক ক্রিকেটারের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে দ্রাবিড়। ১৭৯ তাড়া করতে গেলে ক্যাপ্টেনের যে আস্থাটা টিমের দরকার পড়ে। ব্যাটিং অর্ডারে রোজ ওলট-পালট করে ও। সিমিং উইকেটে (আজ যেমন ছিল) ও ওপেন করে। যাতে উইকেট পড়াটা আটকানো যায়। পাটা উইকেটে আবার নিজে নীচে নেমে উপরে পাঠায় ওয়াটসনকে। এতেই বোঝা যায়, অধিনায়ক দ্রাবিড়ের মস্তিষ্ক কতটা ভাল। আর টিমের জুনিয়রদের প্রেরণা জোগানোর ক্ষেত্রে তো অদ্বিতীয়। এই যে আজ স্টুয়ার্ট বিনি ১৩ বলে ৩২ করে গেল, এই যে সঞ্জু স্যামসন কঠিন পরিস্থিতিতে নার্ভ ঠিক রাখতে পারছে আমি নিশ্চিত, সবই দ্রাবিড়ের জন্য। ও জানে ওর টিমে কোনও তারকা নেই। সঞ্জু, বিনি, এরা কেউ অবিশ্বাস্য প্রতিভাও নয়। কিন্তু দ্রাবিড় জানে, কী ভাবে এদের থেকেও একশো শতাংশ বার করে নিতে হয়। একশোয় বিনিদের প্রতিভা ষাট পেলে, বাকি চল্লিশ দ্রাবিড় ওদের নিংড়ে বার করে নেবে। নিচ্ছেও।
বললাম না, এই আইপিএলটা স্রেফ দ্রাবিড়ের জন্যই মনে রাখা যায়! |
তারাদের কথা |
রাহুল দ্রাবিড়
১১ ম্যাচে ৩০৮ রান। সর্বোচ্চ ৬৫; গড় ৩৪.২২; স্ট্রাইক রেট ১১৫.৭৮; হাফসেঞ্চুরি ৩; বাউন্ডারি ৪১; ওভার বাউন্ডারি ৪ |
সচিন তেন্ডুলকর
১১ ম্যাচে ১৮৬ রান। সর্বোচ্চ ৫৪; গড় ১৬.৯০; স্ট্রাইক রেট ১১৬.৯৮; হাফসেঞ্চুরি ১; বাউন্ডারি ২৪; ওভার বাউন্ডারি ৪ |
রিকি পন্টিং
৬ ম্যাচে ৫২ রান। সর্বোচ্চ ২৮; গড় ১০.৪০; স্ট্রাইক রেট ৬৯.৩৩; বাউন্ডারি ৩; ওভার বাউন্ডারি ১ (এখন ডাগআউটে) |
|