যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারত সরকারের সৌজন্যে রবীন্দ্রনাথকে এখন কথাটা বলা যায়।
রবিবার ‘বিচিত্রা’
নামে যে বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাসম্ভারটির উদ্বোধন করলেন রাষ্ট্রপতি, তাতে রবীন্দ্র-গবেষকদের উপকার
কতটা
হবে তা সময়ই বলবে, কিন্তু পৃথিবীর একটা বড় উপকার হল, বহু গাছ বেঁচে গেল। লিখছেন
আশিস পাঠক |
বাবুমশাই এ বার সত্যিই উড়লেন! অন্তত তাঁর বিপুল পরিমাণ বইগুলি, তাদের শতসহস্র পরিবর্তন-পরিমার্জন সমেত এ বার উড়াল দিল ইন্টারনেটের আকাশে। সৌজন্য, ভারত সরকার এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিচিত্রা’ নামে যে বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাসম্ভারটির উদ্বোধন করলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাতে রবীন্দ্র-গবেষকদের উপকার কতটা হবে তা সময়ই বলবে, কিন্তু আপাতত এই পৃথিবীর একটা বড় উপকার হল, বহু গাছ বেঁচে গেল, ভবিষ্যতেও যাবে।
কোনও পরিসংখ্যান না দিয়েও, স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, বাংলা বই ছাপতে প্রতি বছর যত গাছ খুন হয় তার সিংহভাগ দায় রবীন্দ্রসাহিত্যের। তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ সেই বৃক্ষশ্রাদ্ধ কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজ্য এবং কেন্দ্র দুই সরকারই নতুন রবীন্দ্র-রচনাবলি বই আকারে ছাপায় উদ্যোগী হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি নতুন রচনাবলি ছাপছে। বিশ্বভারতীও, তাদেরই প্রকাশিত দু’টি রচনাবলি থাকা সত্ত্বেও, আর একটিতে হাত দিয়েছে। আর এর বাইরে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্র-গ্রন্থ প্রকাশ প্রায় নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের গতিতে হয়ে চলেছে তো চলেইছে। এবং, বাংলা বই সাধারণত রিসাইক্লড কাগজে ছাপা হয় না। |
রবীন্দ্রনাথের মৌলিক রচনা নিয়েই এই হাল। তার উপরে এক-একটি রচনার যত পরিবর্তন-পরিমার্জন-রূপান্তর তিনি করেছেন সে-সবও উত্তরকালের গবেষণার স্বার্থেই প্রকাশিত হওয়া দরকার। সেই দরকারটা মেটানোর অর্থ আরও বহু বহু বই, আরও কাগজ, এবং তার অর্থ: পৃথিবীকে আরও বৃক্ষশূন্য করা। অতিথি বালক তরুদলকে যিনি নিজের অঙ্গনে ডেকে নেন, বৃক্ষরোপণের মতো উৎসব যাঁর প্রচলন, সেই রবীন্দ্রনাথের কলমের কুঠারে কেন এত গাছ মারা পড়বে? বইয়ের পরে বই জমিয়ে আঁধার হয়ে এল যে সার্ধশতবর্ষ, তাতেও এই জরুরি প্রশ্নটি কেউ তুললেন না। সৌভাগ্যের কথা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগী হয়েছে।
ই-বুক বিষয়টা এখনও বাঙালি পাঠকের তত সড়গড় হয়নি, এমন একটা কথা কেউ কেউ তোলেন। কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যায়, সাধারণ বাঙালি পাঠকের জন্য একটি ছাপা রচনাবলি এবং আলাদা করে রবীন্দ্রনাথের সব বই সুলভ থাকলেই যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথের একই রচনার বিবিধ পাঠ, কালানুক্রমে কিংবা বিবিধ প্রকার অনুক্রমে তাঁর রচনাবলি বই আকারে ছেপে রাখাটা কি খুব জরুরি? সে সব তো মূলত ব্যবহার করবেন গবেষকরা। তাঁদের কাজের স্বার্থেই তাঁরা কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের ব্যবহারটা বরং শিখে নেবেন। এবং সহজে অনুসন্ধান, কপি করা ইত্যাদি সুবিধে ই-বুক-এ আছে, পি-বুক-এ (প্রিন্টেড বুক) নেই। বাড়তি সুবিধে, পোকামাকড়ের উপদ্রবও সে ক্ষেত্রে এড়ানো যাবে।
একুশ শতকে বাঁচলে, মনে হয়, বিষয়টা রবীন্দ্রনাথ নিজেও সমর্থন করতেন। এত লিখেছেন তিনি সারা জীবন, বেঁচে থাকলে লিখতেন আরও। দুর্বল শরীরে কাগজে-কলমে লিখতে আঙুল ব্যথা করত তাঁর। তখন তিনি নিশ্চয় বলে যেতেন আর কোনও সহকারী খটাখট টাইপ করে ই-বুক বানিয়ে ফেলতেন। সে বই না-হয় বিশ্বভারতী-ই প্রকাশ করত আর নেটব্যাঙ্কিংয়ে টাকা দিয়ে দিলে সরাসরি সে বই উড়ে চলে আসত ভক্ত পাঠকের নিজস্ব আই-প্যাডে।
ব্যবস্থাটা সাদরে মেনে নিতেন রবীন্দ্রনাথ, আমি নিশ্চিত। নতুন প্রযুক্তিকে চিরকাল গ্রহণ করেছেন তিনি। কলকাতা থেকে পারস্যে কেএলএম রয়াল ডাচ এয়ারলাইন্সের প্রথম বিমানযাত্রার আমন্ত্রণ উৎসাহের সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনি। সেই উড়ানের ছবি গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছিলেন বাড়ির সকলকে। তাই দেখে এক পরিচারক মন্তব্য করেছিল, ‘বাবুমশাই উড়তিছেন’। সেই নামেই কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় চেয়ারসুদ্ধ উড়ছেন রবীন্দ্রনাথ, খোলা বইটিও। এখন যদি তাঁর নেট-বিহারী বইগুলিকে প্রিন্ট না-নিয়ে, গুগল ক্লাউডে জমা করে রাখেন আজকের পাঠক, ক্ষতি কী!
ক্ষতি নেই, বরং লাভ। তাঁর প্রায় কোনও কথাই সার্থকতার পথে নিয়ে যেতে পারিনি আমরা। অন্তত একটা তো সার্থকতার পথে একটু এগোক, দাও ফিরে সে অরণ্য... |