একশত বৎসর পূর্বে হিন্দি ভাষায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে তৈয়ার করা ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ মুক্তি পাইয়াছিল। ছবির নির্মাতা ছিলেন দাদাসাহেব ফালকে। সেই সূত্রেই মুম্বইয়ের হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্প ‘বলিউড’ আপন জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করিতেছে। দীর্ঘ একশত বৎসর ধরিয়া একটি শিল্পসাম্রাজ্যের টিকিয়া থাকা এবং একের পর এক উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র (এবং অগণিত বিস্মরণযোগ্য নির্মাণও) দর্শকদের উপহার দেওয়া কম সাফল্য নয়। সাফল্য অপেক্ষা সফল আর কী হইতে পারে? এখন প্রতি বছর কেবল বলিউড সহস্রাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করিয়া থাকে। কেবল ২০১০ সালেই এই শিল্প দেশ ও দুনিয়া মিলাইয়া পনেরো হইতে কুড়ি হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করিয়াছে।
প্রশ্ন তবু উঠিতেই পারে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্বের দাবি একা বলিউড করিতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন। বিশেষত আঞ্চলিক চলচ্চিত্র শিল্পে যে বিপুল লগ্নি, নিত্যনব পরীক্ষানিরীক্ষা, ও গুণগত উৎকর্ষের প্রকাশ দেখা যাইতেছে, তাহার প্রেক্ষিতে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। ‘রাষ্ট্রভাষা’য় নির্মেয় বলিউডি সিনেমার প্রাধান্য যে আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতির জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ এবং সরকারি উৎসাহ, দুইই সঙ্কুচিত করিয়া দিতেছে, এই সত্যটি ফিল্ম নির্মাতারা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করিতেছেন। কিন্তু এ কথাও সত্য, হিন্দিতে নির্মিত হওয়ার সুবাদে বলিউডি সিনেমা সারা দেশে যে ভাবে দর্শক টানিতেছে, তাহাতে হিন্দির ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে একটা সর্বভারতীয়তার ধারণাও অবচেতনে সঞ্চারিত হইতেছে। আঞ্চলিক চলচ্চিত্র, মান যাহাই হউক, এ ভাবে নিজেকে অতিক্রম করিতে পারিবে না। তাহার পক্ষে ইহা সম্ভব নয়।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে বলিউডও বিবর্তিত হইয়াছে। এখন মুম্বইয়ে নির্মিত হিন্দি চলচ্চিত্রের দর্শক আন্তর্জাতিক। ইয়োরোপ, আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বলিউডের কদর বাড়িতেছে। ওই সব দেশে বলিউডি চলচ্চিত্রের উৎসবে ভিড় উপচাইয়া পড়ে, বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। বহু বলিউডি ফিল্মের চিত্রগ্রহণ করা হইতেছে বিদেশে। বলিউডকে সাংস্কৃতিক কূটনীতির উপাদান রূপে ব্যবহার করা যায় কি না, সে বিষয়েও ভাবনাচিন্তা চলিয়াছে। সেই কূটনীতির সম্ভাবনা যে কতখানি, পাকিস্তানের সদরে ও মফস্সলে, এমনকী আফগানিস্তানের অলিগলিতেও বলিউডি সিনেমার জনপ্রিয়তা তাহা বলিয়া দেয়। ক্রমে বলিউডি ফিল্মের চরিত্রও পাল্টাইয়াছে, বাঁধা গতের বাহিরে পরীক্ষামূলক ও বুদ্ধিদীপ্ত, বাস্তবানুগ ফিল্ম তৈরির প্রবণতা বাড়িতেছে। দর্শক-চাহিদার বৈচিত্রও উত্তরোত্তর প্রসরমাণ, চাহিদা ও জোগানের মূল সূত্র মানিয়াই চিত্রনির্মাতারা ছক ভাঙিতেছেন। দর্শকরা এখন আর রাজা হরিশ্চন্দ্রের নীতিকথায় তুষ্ট হয় না, তাঁহাদের চাহিদা পরিবর্তিত। স্বপ্নের ফেরিওয়ালার রকমসকমও তাই আমূল বদলাইয়া গিয়াছে। শতবর্ষ দীর্ঘ সময়। |