লোকসভার বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে সংসদীয় প্রক্রিয়া অন্তত কিছুটা কার্যকর হইবে, অন্তত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন-প্রস্তাব লইয়া জনপ্রতিনিধিরা যথার্থ বিতর্ক করিবেন, নাগরিকরা যদি এই প্রত্যাশা করিয়া থাকেন, তাঁহাদের দোষ দেওয়া চলে না। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁহারা অনেক বড় বড় কথা অহরহ শুনিয়া থাকেন। ছাত্রপাঠ্য বইতেও সেই গণতন্ত্রে আইনসভার মর্যাদাময় ভূমিকার সবিস্তার আলোচনা থাকে। নিয়মিত নির্বাচনের সময় নাগরিকরা যখন ভোটদানের পঙক্তিতে দাঁড়ান, তখন এই ভূমিকাটির কথা নিশ্চয়ই তাঁহারা স্মরণ করেন এবং গর্বিত বোধ করেন। অথচ, যখন ভারতীয় গণতন্ত্রের এই মর্যাদাময় প্রতিষ্ঠানটির বাস্তব রূপটিকে তাঁহারা দেখেন, তখন প্রাণে যে অনুভূতির উদয় হয়, তাহা আর যাহাই হউক, গৌরব নয়। বর্তমান লোকসভার চিত্রটিই প্রকট নজির। লোকসভারই সচিবালয়ের এক সমীক্ষায় স্পষ্ট, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পঞ্চদশ আইনসভার মেয়াদ চার বছর কাটিয়া গেলেও তাহার অধিবেশন বসিতে পারিয়াছে মাত্র ১১৫৭ ঘণ্টা। ইহার মেয়াদ পূর্ণ হইতে আর এক বছরও অবশিষ্ট নাই। নিঃসংশয়ে বলা চলে, অধিবেশনের সময়কালের নিক্তিতে পঞ্চদশ লোকসভাই নিষ্ফলতম বলিয়া গণ্য হইবে। বাজেট অধিবেশনের পুনরারম্ভ হইতেই যে ভাবে সভার কাজ পণ্ড হইতেছে, তাহাতে ঘুরিয়া দাঁড়াইবার কোনও লক্ষণও নাই। ভারতের নাগরিকরা যদি তাঁহাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রশ্ন করেন, এমন লোকসভা রাখিয়া লাভ কী, তাহার জন্য এমন বিপুল অর্থ ও শ্রম ব্যয় করিয়া নিয়মিত নির্বাচনেরই বা কী প্রয়োজন মহামান্য সাংসদ ও বিধায়করা সদুত্তর দিতে পারিবেন না। কারণ সদুত্তর নাই।
এই অবক্ষয় আকস্মিক নয়। আশির দশক হইতেই সংসদের অধিবেশন এ ভাবে হ্রাস পাইয়াছে। একই সঙ্গে সাংসদদের মধ্যে উন্নত মানের বিতর্কের পরিবর্তে চিৎকার, আস্ফালন, এমনকী বাহুবলেরও আধিক্য ঘটিয়াছে। যদি খেয়াল করা যায় যে রাজনীতির মণ্ডলায়ন-উত্তর পর্বেই এই প্রবণতা বর্ধমান, তবে ইহাকে ভারতীয় গণতন্ত্রের তথাকথিত ‘গভীরগামিতা’র অপরিহার্য অনুষঙ্গ রূপে শনাক্ত করা সহজ হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের গভীরগামিতা কি কেবল নির্বাচিত আইনসভায় জনগণের বিভিন্ন অংশের, সব জনগোষ্ঠী, অঞ্চল, জাত, উপজাতের সংখ্যাগত প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করার বিষয়, না কি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ, চেতনাকে জনসাধারণের সর্ব অংশের মধ্যে প্রোথিত করার কার্যক্রম? প্রথমটি গ্রহণ করিলে মানিতেই হইবে, মণ্ডল-উত্তর পর্বে সর্ব স্তরের প্রতিনিধিত্বে নির্বাচিত আইনসভাগুলি উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হইয়াছে। সেই অনুপাতেই কিন্তু যথার্থ বিতর্ককে বিদায় করিয়া চিৎকার, মারমুখী উচ্ছৃঙ্খলতা এবং সঙ্কীর্ণ, গোষ্ঠীগত ও আঞ্চলিক স্বার্থের কাজিয়ায় সংসদ নির্লজ্জ ভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। সংসদ বহিরঙ্গ রূপে বহুমুখী, বহুদলীয় ও বহুমাত্রিক প্রতিনিধিত্বের আপাত গণতান্ত্রিক চেহারায় মণ্ডিত হইয়াছে, কিন্তু সেই একই প্রক্রিয়ায় অতি দ্রুত সংসদের মানেরও অবনমন ঘটিয়াছে। সংসদীয় বিতর্ক ও আলোচনার গুণগত উৎকর্ষ অন্তর্হিত হইয়াছে।
মূল প্রশ্নটি সহজ ও স্পষ্ট। সংসদের অধিবেশন ভণ্ডুল করা, স্পিকারকে অধিবেশন মুলতুবি করিতে বাধ্য করা, ‘ওয়েল’-এ নামিয়া গিয়া সংসদের নথিপত্র ছিঁড়িয়া, মাইক্রোফোন ভাঙিয়া স্লোগান দিয়া ওয়াক-আউট করা কেমন করিয়া গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ বলিয়া গণ্য হইতে পারে? অথচ ক্রমশ ইহাই হইয়া উঠিয়াছে দস্তুর। কেবল গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষাকারী ছোট ছোট দলই নয়, শাসক ও বিরোধী তথাকথিত জাতীয় দলের সাংসদরাও ক্রমশ দায়িত্বজ্ঞানহীন উচ্ছৃঙ্খলতা দেখাইয়াছেন। শাসক পক্ষেরও আগের নৈতিক কর্তৃত্ব অবশিষ্ট নাই, যাহার সাহায্যে ট্রেজারি বেঞ্চের প্রভাবশালী সদস্যরা বিরোধী পক্ষের সাংসদদের সহিত অধিবেশন চালু রাখা বিষয়ে আগাম সমন্বয় করিয়া চলিতে পারেন। আর বিরোধী পক্ষেরও সেই দায়িত্ববোধ নাই, যাহা তাঁহাদের গণতন্ত্রের এই সর্বোচ্চ পীঠস্থানটিকে পদে-পদে অন্তর্ঘাত করার বিপথগামিতা হইতে নিরস্ত করে। ফলে সংসদ উত্তরোত্তর অফলপ্রসূ হইয়া পড়িতেছে। বলি হইতেছে কিন্তু গণতন্ত্র। |