তারাবাজি
কাজে ডুবে থাকা মানুষ মানেই তো ‘তারক’

পিআর কে দেখে আপনার?
আমার তো কোনও পিআর দেখার লোকটোক নেই। কেন বলছেন এ কথা?

পি আর থাকলে এখনই তাঁকে স্যাক করা উচিত। এই রকম দাপুটে অভিনেতা আপনি। ‘শব্দ’ করার আগে আপনাকে সে ভাবে কেউ চিনতই না! এটা তো পিআর-এর ব্যর্থতা!
হা হা হা। এ ভাবে বলবেন না। একটুআধটু চিনত বইকী।

পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন আপনি হলেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ইরফান খান। কিন্তু এত মুখচোরা হলে কী ভাবে চলবে? ভাল অভিনয়ের সুযোগ তো তা হলে আসবে না বারবার?
আমি তো মুখচোরা নই। যাঁরা কাজ দেন, সেই সব পরিচালকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ও আছে। যখন দেখা হয় সহজ স্বাভাবিক কথা বলি। আর দুয়েকটা পার্টিতে না গেলে কাজ পাব না এটা আমার মনে হয় না।

‘শব্দ’ পুরস্কার পেল। আপনার কি একটা পুরস্কার প্রাপ্য ছিল না?
হা হা হা। (সরবে হাসি) সকলেই বলছেন এমন কথা। এটাই তো একটা বড় পুরস্কার। তবে এ নিয়ে কোনও স্বপ্ন ছিল না আমার। এ বার সেরা অভিনেতার পুরস্কার দু’জন পেয়েছেন। ইরফান খান এবং একজন মরাঠি শিল্পী। মরাঠি ছবিটা আমি দেখিনি। কিন্তু ‘পান সিংহ তোমর’-এ অভিনয় করে ইরফান খুবই যোগ্য অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন।

আপনার স্ত্রী অপরাজিত ঘোষ দাস তো অভিনেত্রী। ওঁর কেমন লাগল আপনার অভিনয়?
ভাল লেগেছে। আমাকে ‘শব্দ’র কাজটা করার সময় খুব অনুপ্রেরণাও দিয়েছিল।
ছবি: সুব্রত কুমার মন্ডল
আপনারা দু’জনে কী ভাবে সময় কাটান?
অনেক সিনেমা দেখি একসঙ্গে। অভিনয় নিয়েও প্রচুর আলোচনা হয়। আর আমি নিজে বই পড়তে ভালবাসি। অমর্ত্য সেনের প্রবন্ধ থেকে ফেলুদা সবই পড়ি। আমরা দু’জনেই খুব বেড়াতে ভালবাসি। এই তো কিছুদিন আগে আমরা বেনারস বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরে এক সপ্তাহের জন্য চলে যাই সান্দাকফু। সান্দাকফু থেকে ফিরে একুশ দিনের জন্য কুমায়ুন বেড়াতে গিয়েছিলাম।

ফলি আর্টিস্ট তারকের চরিত্রে অভিনয় করার সময় কতটা অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন পরিচালকের কাছ থেকে? আর কতটা বা নিজের গড়ে তোলা?
ছবিটা করার যখন প্ল্যান হয়, তখন আমি ঠিক করি ফলিটা আমি চোখে দেখব। তখন আমি তিন দিন মতো ফলি আর্টিস্ট গয়াদার (গয়াধর নায়েক) কাজ দেখেছিলাম। তখন ‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’য়ের কাজ হচ্ছিল। তার পর কৌশিকদাও আমাকে ফলি হচ্ছে এমন কিছু ভিডিও ক্লিপিংস দেখায়।

কেমন লেগেছিল প্রথম গয়াকে দেখে?
ও তো খুব সহজেই কাজটা করে। এমন ভাবে করে মনেই হয় না দেখে খুব কঠিন একটা কাজ করছে। আরামসে সিন করতে করতে একটা রিকশার টুংটাং শব্দের ফলি করে ফেলল, তার পরেই হয়তো জল পড়ার শব্দ ফলি করল। সব ব্যাপারেই ও খুব পেশাদার। গয়াদার কাজ দেখে চরিত্রটাকে যখন ভাবতে আরম্ভ করলাম তখন কৌশিকদার সঙ্গে অনেক কথা হয়। তারক ছেলেটি আত্মভোলা হলেও সকালে এলআইসির কাজ করে, বিকেলে ফলির কাজ করে। পরিবারের প্রতি তার একটা দায়বোধও আছে। কিন্তু ও যে অসুস্থ সেটা ও জানে না। ও যা করছে সেটা ওর কাছে একদম ঠিক। এই ভাবে ভেবেই চরিত্রটা মনের মধ্যে গড়া হয়ে যেতে থাকে।

তারকের মধ্যে ফলির কাজটা করার ব্যাপারে যে একাগ্রতা আছে, সেটা নিখুঁত ভাবে ফোটালেন কী করে?
চরিত্রটাই যে ওই রকম। কাজে ডুবে থাকে। এমনকী পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েও নিজের কথা বলে। প্রকৃতির শব্দ, গাছের পাতার শব্দ, ঝরনার শব্দ শুনতে শুনতে নিজস্ব শব্দজগতের মধ্যে বিভোর হয়ে যায়। এ সবই তো স্ক্রিপ্টে ছিল।

এত অভিনেতা থাকতে পরিচালক আপনাকে হঠাৎ ফলি আর্টিস্টের চরিত্রের জন্য বাছলেন কেন?
কৌশিকদা বলে, আমার অভিনয়ের মধ্যে নাকি ‘কেউ না’ এ রকম একটা লোক হয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে। সেটা তারকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সে মানুষের ভিড়ে মিশে থাকা মানুষ।

আপনার কি মনে হয় আপনার মধ্যে একটা ভিড়ে মিশে যাওয়া মানুষের ছাপ আছে?
আমার মুখে সাঙ্ঘাতিক একটা বিশেষত্ব নেই যেটা সাধারণত হিরোদের থাকে। এটা আমার মনে হয়।

এই চরিত্র হিসেবে রোল মডেল শুধু গয়াই ছিলেন? না কি আর কেউ ছিল?
সারা জীবন বহু কাজে ডুবে থাকা মানুষ দেখেছি, গয়াদা ছাড়াও তাঁদের কথাও মনে হয়েছে ‘তারক’ করার সময়।

যে প্যাশনটা তারক করার সময় আপনি ঢেলে দিয়েছেন সেটা কী ভাবে এল। এই যে প্রতি মুহূর্তে উৎকর্ণ হয়ে নানা শব্দ শোনা, আর সেই উদগ্রীব ভাবটা চোখে মুখে ফুটিয়ে তোলা—কী করে করলেন?
কী করে করলাম বলতে পারব না। আমি চেষ্টা করেছিলাম চরিত্রটার রক্তমাংস ছুঁতে। ‘তারক’এর ‘শব্দ’র প্রতি তীব্র প্যাশনটাই যে ‘তারক’ সেটা আমি মনে প্রাণে বুঝেছিলাম। কখনও যে তারক নিজের কাছে অসুস্থ নয়, পাগলও নয় সেটা চরিত্রটার মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। বারবারই মনে রেখেছি তারকের অভিনয়টা যেন পাগলামি না হয়, প্যাশনই হয়। আমার তো মনে হয় সমস্ত কাজে ডুবে থাকা মানুষকেই বাইরে থেকে তারকেরই মতো দেখতে লাগে।

আমি
৩৬
ঈশ্বরে বিশ্বাস: ভাবিনি কখনও
বেনারস
প্রিয় নাটক: জগন্নাথ
অপরাজিত
প্রিয় বই: জীবনানন্দ দাশের কবিতা
মায়ের হাতের পোস্তর পদ
ভয়: লোভকে

কোন কোন দৃশ্য করা খুব কঠিন মনে হয়েছে?

পাহাড়ে বৌয়ের (রাইমা সেন) সঙ্গে শটটা একটু ডিফিকাল্ট ছিল। ওই যে ফলি করার খেলা খেলতে খেলতে রাইমাকে যখন ফলো করছে তারক সেই শটটার কথা বলছি। আর বেড়াতে গিয়ে মদ খাওয়ার দৃশ্যটা যেখানে রাইমা কোনও কথাই বলছে না, আমারই ডায়লগ চলেছে। কথা বলতে বলতে তারক হাই হয়ে যায়, অনেকগুলো মুডও শিফট হয়—ওই জায়গাটা বেশ কঠিন ছিল। আমি ওই জায়গাটা খুব ভেবে করেছিলাম।

পায়রা ওড়া বা বন্দি হাঁটার শব্দে যে ফলি করেছিলেন, তখন কেমন লাগছিল?
ওগুলো কোনও দিন করিনি তো। খুব মজা লাগছিল। আর বড় স্ক্রিনে আমার ফলিটা দেখাও যাচ্ছিল। আমার দুই বন্ধুর একটা স্টুডিয়ো আছে। জোজো-পটলার স্টুডিয়ো নামেই লোকে চেনে। ওরা আমায় বলে কী, “তুমি আমাদের পরের ছবির ফলি করে দাও। সবই তো শিখে গিয়েছ।” জোজো-পটলার ভাল নাম যথাক্রমে অনির্বাণ সেনগুপ্ত ও দীপঙ্কর চাকী। ওরা ‘শব্দ’র জন্য সেরা ডিজাইনিংয়ের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে।

এ ছবিতে এমন কোনও দৃশ্য আছে যে দৃশ্য করে মনে হয়েছে অভিনেতা হিসেবে আপনার একটা উত্তরণ ঘটেছে?
আমার অভিনয় করতে যত ভাল লাগে, নিজেকে সিনেমায় দেখতে ততটাই বিরক্ত লাগে।

আর কোন ছবিতে কাজ করে এই ধরনের পরিতৃপ্তি পেয়েছেন?
অতনু ঘোষের ‘এক ফালি রোদ’ ছবিতে প্রমিনেন্ট কিন্তু ছোট একটা চরিত্র করে স্যাটিসফেকশন পেয়েছি। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ বলে একটা ছবিতে অভিনয় করেও খুব আনন্দ পেয়েছি। ওখানেও আমার অন্য রকম অভিনয় করার সুযোগ ছিল।

‘শব্দ’তে কাজ করার পর জীবনটা কি বদলে গিয়েছে?
জীবন আর কী বদলাবে? খুব শ্রদ্ধেয় অভিনেতারা যেমন অঞ্জন দত্ত, দীপঙ্কর দে, দুলাল লাহিড়ি —এঁরা আমার খুব প্রশংসা করেছেন। তাতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।

আর ভাল কাজ করার আকাঙ্ক্ষা বাড়েনি?
না, আকাঙ্ক্ষা বাড়েনি।

সেটা তো খুব মধ্যবিত্ত মানসিকতার লক্ষণ।
হতেই পারে। হতে পারে এটা আমার নিরাসক্তি। সত্যি কথা বলতে কী ভাল ভাল রোল পাব এই স্বপ্ন দেখে মনের ভেতর একটা খেয়ালি পোলাও রান্না করতে আমি চাই না। শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন ভঙ্গ হলে নিজেকেই উত্ত্যক্ত করা হয়।

কোন কোন অভিনেতার অভিনয় আপনার ভাল লাগে?
এই যে কৌশিকদা আমাকে বাংলার ইরফান বলেছেন এটা শুনে আমার খুব ভাল লাগছে। ইরফান আমার খুব পছন্দের অভিনেতা। আর অসম্ভব প্রিয় নাসিরউদ্দিন শাহ, স্মিতা পাটিলের অভিনয়।

এই ছবিটা করার পর শব্দজগৎটা আপনার কাছে কী ভাবে ধরা পড়ছে?
শব্দের নানারকম বৈচিত্র আমার জীবনে বহু আগেই ধরা পড়েছে। মফস্সলের ছেলে। বাড়ি ব্যারাকপুরে। কলকাতা শহরের বাইরের সাউন্ডস্কেপটা একেবারেই আলাদা। ল্যান্ডস্কেপ বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে সাউন্ডস্কেপও বদলে যায়। বেড়াতে গিয়ে কত রকম শব্দ শুনি প্রকৃতির। এটা আমার কাছে একটা খেলা। সেই শব্দ যে এমন করে জীবনে ঢুকে পড়বে ভাবিনি। আমি যেখানে থাকি, কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান এলাকায়, সেখানকার সাউন্ডস্কেপটা অন্য রকম। হারমোনিয়ামে গলা সাধা, সন্ধে হলে শাঁখ বাজা, ছেলেদের মাঠে হইহই করে খেলার শব্দ মিলিয়ে একটা অন্য শব্দজগৎ এই কলোনি সংস্কৃতির মধ্যে। ‘শব্দ’ করার পর এই সব সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো আরও বেশি করে উপভোগ করছি।

স্ত্রী অপরাজিতা ঘোষ দাসের সঙ্গে ঋত্বিক চক্রবর্তী। ছবি: অনিন্দ্য শঙ্কর রায়

আমরা দু’জনেই খুব বেড়াতে ভালবাসি। কিছু দিন আগে বেনারস গিয়েছিলাম।
সেখান থেকে ফিরে এক সপ্তাহের জন্য সান্দাকফু। সান্দাকফু থেকে ফিরে আবার কুমায়ুন বেড়াতে গিয়েছিলাম

‘শব্দ’ কি সিনেমার কলাকুশলীদের জীবন বদলাবে? তাঁরা কি আগের চেয়ে বেশি সম্মান পাবেন?
না। জীবন বদলাবে না। সম্মান বেশি পাবে বলেও মনে হচ্ছে না। তবে তাঁদের সম্পর্কে চারপাশের মানুষের সচেতনতা বাড়তে পারে। বহু টেকনিশিয়ানের অক্লান্ত পরিশ্রমে একটা ছবি তৈরি হয়। ‘শব্দ’ করার পর সিনেমা সম্পর্কে এটা আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ রিয়ালাইজেশন।

এখন আপনার হাতে কাজ কী রকম?
নতুন দুটি ছেলেমেয়ের পরিচালনায় ‘তিন পাত্তি’ বলে একটা ছবিতে অভিনয় করব। আর অন্য সব ছবি এখনও কথাবার্তার স্তরে।

আপনি মূলত টেলিভিশন তারকা। সেই জন্যই কি সিনেমায় এত কম কাজ হয়?
না। আমার সেটা একেবারেই মনে হয় না। এ পর্যন্ত ‘ক্রস কানেকশন’, ‘চলো লেটস গো’, ‘নেকলেস’—এ সব ছবিই টেলিভিশনে কাজ করতে করতে করেছি। এমনকী ‘শব্দ’ও। অসুবিধে তো কিছু হয়নি।

এখন টেলিভিশনের কাজ কি বন্ধ?
না, তেমন কোনও ব্যাপার নয়। অনেক দিন টিভিতে কাজ করেছি বলে একটু রেস্ট নিচ্ছি। ভাল সুযোগ পেলে আবার টেলিভিশনে কাজ করব।

আপনার কি ‘পাগলু’ বা ‘চ্যালেঞ্জ টু’র মতো ছবিতে অভিনয় করার ইচ্ছে নেই?
আমার মনে হয় না এই ধরনের ছবিতে অভিনয় করতে খুব স্বচ্ছন্দ হব। এবং মনে হয় না আমাকে নিয়েও পরিচালকেরা খুব স্বচ্ছন্দ হবেন। তবে ‘লে ছক্কা’ ছবিতে একটা চরিত্র করে আমার বেশ ভাল লেগেছিল।

‘শব্দ’তে আপনার জায়গায় যদি শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করতেন কেমন হত?
খুব বিশ্বাসযোগ্য একটা অভিনয় আমরা দেখতে পেতাম। পেতাম একেবারে অন্য ধরনের অপুদাকে (শাশ্বত)।

শাশ্বত বেশ বেশি বয়সেই সেরা অভিনয়ের দৃষ্টান্তগুলো রাখতে রাখতে চলেছেন। আপনার ক্ষেত্রেও তো সেটা হতে পারে।
তা তো হতেই পারে। তা না হলে বিনোদন জগতে আসার এত দিন পরে ‘শব্দ’ দেখে মানুষ আমার সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত তো হলেন। এর পরে হয়তো আরও ভাল কাজের সুযোগ আসবে, যেখানে আমি নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাব।
কিন্তু হ্যাঁ। আমি কিন্তু এ সব স্বপ্নটপ্ন দেখার ব্যাপারে খুব নিরাসক্ত। সেটা আগেও বলেছি। এখনও বললাম।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.