|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
মানবীমুখের চারুতায় ঢাকা পড়ে যায় উষ্ণতা |
অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল সুব্রত চৌধুরী ও শেখর করের যৌথ প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
মানুষের মনের দর্পণ হল মুখ। এক জন শিল্পী যখন মুখ আঁকেন, তখন তিনি শুধু সাদৃশ্যকেই বোঝাতে চান না। মেলে ধরতে চান সেই ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর বোধ এবং নিজস্ব জীবনদর্শনও। মুখের ভিতর দিয়ে শিল্পী সমকালকেও প্রতিবিম্বিত করেন।
অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি একসঙ্গে প্রদর্শনী করলেন শিল্পী সুব্রত চৌধুরী এবং শেখর কর। তাঁদের দু’জনেরই ছবির মূল উপজীব্য মানবীমুখ। প্রদর্শনীর শিরোনাম দিয়েছেন তাঁরা ‘চারুচৈত্র’। চৈত্রের উষ্ণতাকে মানবীমুখের চারুতা দিয়ে শমিত করতে চেয়েছেন কি তাঁরা? তাঁদের ছবি বলে, তাঁরা আরও একটু বেশি কিছু চেয়েছেন। প্রদর্শনীতে তাঁদের সঙ্গে ছিলেন তরুণতর তৃতীয় এক জন শিল্পী অর্পণ দাস। তিনি অবশ্য শুধু মুখ আঁকেননি। অবয়বের ভিতর দিয়ে নৈরাশ্যের অন্তরে প্রবেশ করেছেন।
সুব্রত ও শেখর দু’জনেই ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকে এঁকেছেন। সুব্রতর ছিল ৩১টি ছবি, শেখরের ৩৫টি। একই মাধ্যম হলেও প্রয়োগের ধরন দু’জনের ছবিতে দু’রকম অভিব্যক্তি এনেছে। সুব্রতর নারীমুখগুলি অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতায় আঁকা হলেও তাদের অভিব্যক্তি কল্পরূপাত্মক। তারা এই
|
শিল্পী: সুব্রত চৌধুরী |
সময়ের মধ্যে অবস্থান করেও যেন কেবল এই সময়েই আবদ্ধ হয়ে নেই। অতীতের রহস্যময়তাকে তারা সঞ্চারিত করছে এই সময়ের মধ্যে। সুব্রতর ছবিতে ‘ফ্যানটাসি’ অনেক সময়ই সুররিয়ালিজমের দিকে চলে গেছে। সেই ফ্যানটাসি ‘সারফেস টেক্সচার’ বা উপরিতলের বুনোটে বর্ণের এমন এক বিন্দুমাত্রিক বিচ্ছুরণ সৃষ্টি করেছে এবং এমন এক উজ্জ্বলতা এনেছে যা অনেকটা টেম্পারার সমধর্মী।
কোনও ছবিরই কোনও শিরোনাম নেই। তাই নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করা মুশকিল। একটি ছবিতে দেখা যায় একটি মেয়ে বসে আছে পুরোনো দিনের একটি গ্রামোফোনের সামনে। বিশাল চোঙওয়ালা সেই গ্রামোফোন স্মৃতির অতীতকে মেলে ধরেছে। তার সামনে বসে এই সুন্দরী যুবতী অতীতের সুর দিয়ে নিজের বর্তমানকে উদ্ভাসিত করতে চাইছে। এই অতীত চেতনা এক ধরনের রোমান্টিকতার আবেশ আনে তাঁর ছবিতে। আর একটি ছবিতে দেখা যায় একটি মেয়ের মুখকে একেবারে সামনে থেকে ধরেছেন। নিপুণ যত্নে এঁকেছেন মাথা থেকে দু’পাশের কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে আসা চুলের গুচ্ছ। এই চুলের ভিতর যেন বিধৃত হয়ে আছে অতীত। ‘চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা’ অতীতের এই ঝংকৃত অন্ধকার দিয়ে শিল্পী যেন বর্তমানের রহস্যময়তাকে অনুধাবন করতে চেয়েছেন। একটি মেয়ের হাতে ধরা রয়েছে বাঘের মুখ। হিংস্রতাকে সে যেন ভালবাসা দিয়ে জয় করতে চাইছে। একটি মেয়ের মাথার উপরে বহু শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট হরিণের শিং। বন্যতার সঙ্গে নিষ্কলুষ সরলতার সমন্বয়ের প্রকাশ এখানে। মানবী-প্রকৃতি, অতীত-বর্তমান, বন্যতা-সভ্যতা এ রকম নানাবিধ দ্বৈতকে নিয়ে খেলতে ভালবাসেন এই শিল্পী। খেলতে খেলতে বর্তমানের ভিতর এক মায়াকে উদ্ভাসিত করেন। সেই মায়ার দর্পণে জীবনের গভীরকে নিরীক্ষণ করতে চান। শেখরের ছবি তুলনায় অনেক বর্তমান-ভিত্তিক। মানবীর বর্তমানের দুঃখসুখের দ্বৈতের বিশ্লেষণ উঠে আসে তাঁর ছবিতে। সেই বিশ্লেষণ তিনি করেন আলো-অন্ধকারের দ্বৈতের মায়া দিয়ে। অ্যাক্রিলিককে তিনি অনেকটা তরল করে ব্যবহার করেছেন জলরঙের মতো। সজলতার সঙ্গে অন্তর্মুখীনতা মিশেছে। তৈরি হয়েছে রহস্যময়তা। তাঁর ছবির অন্ধকারের উপর এসে পড়ে উৎসবিহীন আলো। অন্ধকারের সঙ্গে এই আলোর স্তব্ধ অথচ সুরেলা সংলাপ তাঁর ছবির প্রধান উপজীব্য। তাঁর প্রকাশভঙ্গি মূলত অভিব্যক্তিবাদী। অবয়বের জ্যামিতিকে রেখার গাঠনিকতা দিয়ে তিনি খুব একটা ভাঙেন না। বরং বিভিন্ন বর্ণের সমাহারের মধ্যে এক ধরনের নাটকীয়তা গড়ে তোলেন। যা খুব উচ্চকিত নয়। অন্তর্মুখী। এর ভিতর দিয়েই শিল্পী মানবীর মনের রহস্য অনুধাবনের চেষ্টা করেন। শুধু মানবীমুখ নয়, তাঁর ছবিতে এসেছে আরও নানা বিষয়। প্যাঁচা, গরু বা ছাগলের মুখ, ফুলদানিতে ফুল ইত্যাদি। এ সবের ভিতর দিয়ে পরিষ্ফুট হয়েছে বাংলার রহস্যময় সৌন্দর্য।
অর্পণ তেলরঙে এঁকেছেন মাত্র চারটি ছবি। নাগরিক জীবনের সংঘাত ও স্বৈরাচারকে তুলে ধরেছেন তিনি। বুঝতে চেয়েছেন এই জীবনের নিহিত সংকট। দু’টি ছবি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি ছেলের মুখে কালো আবরণ, নগ্ন এক জন মানুষ তার জামাটি খুলে ফেলছে। দ্বিতীয় ছবিটিতে একটি শিশুর মুখ। |
|
|
|
|
|