অন্যের মাঠে পর পর দু’টো হারের ধাক্কা সামলে আমরা আবার ফিরে এসেছি কলকাতায়। চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে হারলেও ওই রকম দুর্দান্ত রান তাড়া করতে পারাটা আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও মজবুতই করেছিল। কিন্তু দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ম্যাচে আমরা আরও একবার অতি জঘন্য খেললাম। হাতে আর ছ’টা ম্যাচ আছে। টুর্নামেন্টে টিকে থেকে পরের স্টেজে যেতে হলে আমাদের ওই ছ’টাই জিততে হবে। না পারলে অন্তত পাঁচটা তো জেতা চাই-ই। অনেক মহলে ইতিমধ্যেই কেকেআর-কে বাতিলের দলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অনেকে তো এত দূরও বলতে শুরু করেছে যে, গত বছর আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা নাকি স্রেফ ফ্লুক ছিল! সরি, মানতে পারছি না। কারণ কোনও ভাল টিমকে এত তাড়াহুড়ো করে বাতিলের দলে ফেলে দেওয়া যায় বলে আমি অন্তত মনে করি না।
টেলিভিশন প্রেজেন্টার হিসেবে প্রাক্তন হ্যাম্পশায়ার অধিনায়ক মার্ক নিকোলাসকে আমার বেশ ভাল লাগে। |
ভারতের শেষ অস্ট্রেলিয়া সফরে চ্যানেল নাইনের হয়ে ওঁকে উপস্থাপনা করতে দেখেছিলাম। বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচের শো-র শুরুটা উনি যে ভাবে টানেল থেকে বেরিয়ে আসার শট দিয়ে শুরু করেছিলেন, সেটা আমার অসাধারণ লেগেছিল। আসলে কোনও প্রতিযোগিতা নিয়ে অকারণ হাইপ আর নাটক আমার এক্কেবারে না-পসন্দ। সম্ভবত সেই কারণেই নিকোলাস যে ভাবে দর্শকের মনে একেবারে সঠিক পরিমাণ উদ্বেগ আমদানি করে ওই টেস্টের বিল্ড আপটা করেছিলেন, সেটা আমার মনে ধরেছিল।
তবে উপস্থাপনার ধরন ছাড়াও নিকোলাসের ড্রেস সেন্সও আমার ভীষণ পছন্দ। আমার মতে প্রেজেন্টার বা কমেন্টেটরদের মধ্যে উনিই সব থেকে ভাল কাটের স্যুট পরেন। সাধারণত স্যুটের রংগুলোও ভীষণ স্মার্ট হয়।
তো নিকোলাস সম্প্রতি এক ক্রিকেট ওয়েবসাইটে নিজের লেখায় জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াকে তাদের হারানো ক্রিকেটীয় শৌর্য ফিরে পেতে হলে ক্রিকেট মাঠে ঠিক কী কী করতে হবে। সুন্দর লেখা। পড়তে ভাল লাগে। বিশেষ করে এই অংশটা তো আমার দারুণ লেগেছে: “বলা হয়েছিল, ১৯৮৯ সালে যে দলটা অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে রওনা দেয়, সেটাই নাকি খাতায়-কলমে ছিল অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সব থেকে খারাপ টিম। তবে তকমাটা ততক্ষণই ১৯৮৯-র দলের গায়ে লেগে আছে যতক্ষণ না মাইকেল ক্লার্কের এই দলটা অ্যাসেজ খেলার জন্য রওনা দিচ্ছে। অন্য দিকে, ১৯৫৮ সালে পিটার মে-র নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে যখন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এসে পা দিয়েছিল, তখন তাদের বলা হচ্ছিল সর্বকালের সেরা দল। হ্যাঁ, সর্বকালের সেরা! ফলে ওই দু’বারই অজিদের জন্য কোথাও কোনও আশার আলো ছিল না। আর রেজাল্ট কী হল? দু’বারই অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ৪-০। |
ক্রিকেটটা খাতায়-কলমে খেলা হয় না। ক্লার্ককে এ বার অন্যদের প্রতি এত ভদ্রতা দেখানো বন্ধ করে ডার্টি হতে হবে। হয় সেটা, আর না হলে ওকে রিচি বেনোর মিডাস টাচ খুঁজে পেতে হবে।”
কোনও খেলাই কাগজে খেলা যায় না। কাগজ হল বিশ্লেষণের জন্য। কিংবা সেরা দিনগুলোয় খেলোয়াড়দের মনে কিছুটা প্লাস্টিক আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার জন্য। আসল যুদ্ধটা তো হয় বাইশ গজে। আর কেকেআরের ব্যাপারটা হল, কাগজে-কলমে আমাদের যতই ঝকঝকে দেখাক না কেন, ওই বাইশ গজের আসল লড়াইটায় আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটিং ব্যবস্থার উত্তরাধিকার আমরা এখনও পাইনি। আইপিএলের অন্য কয়েকটা দলে প্রতিভার ভাঁড়ার মজুত রয়েছে। তেমন কোনও বিলাসিতা অবশ্য আমাদের দলের নেই। কিন্তু যেটা আমাদের আছে, নিকোলাস সেটাই চাইছেন ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে। আমরা অন্যদের সঙ্গে অকারণ ভদ্রতা করি না আর জেতার জন্য ঝাঁপাতে ডার্টি হওয়া পছন্দ করি। মিডাসের স্পশর্র্? সেটা তো শব্দ নিয়ে লেখকের খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। খেলার দুনিয়ায় শুধু ভাল রণকৌশল গড়া আর মাঠে নেমে সেটা কাজে করে দেখানোর সুযোগ রয়েছে। এই দু’টো ব্যাপার যদি ঠিকঠাক হয়, নিকোলাসের মতো লেখকরা সেটাকেই ‘মিডাস টাচ’ বলার সাহিত্যিক-স্বাধীনতা নেন।
আইপিএলের মাঠে আমাদের হারগুলোর পাশে আরও একটা ঘটনা আমার অনেকটা চিন্তা দখল করে নিয়েছে। সর্বজিৎ সিংহের মৃত্যু। ওঁর পরিবারকে সমবেদনা জানানোর জন্য রাজনীতিকদের মধ্যে আবার দেখছি সেই নিয়মমাফিক রেষারেষি শুরু হয়েছে। এটা সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক। আজকাল এটা একটা যেন ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছে-- প্রথমে ক্ষোভে ফেটে পড়া, তার পরে চোখের জল (সত্যিকারের এবং গ্লিসারিন মিশ্রিত)। আর থাকবে মোমবাতি মিছিল। সর্বজিৎ আর ফিরবেন না। জানি না আমার কাছে কতটা সঠিক তথ্য রয়েছে। তবে যা শুনছি, পাকিস্তানের জেলে এখনও কমকরে দু’শো ভারতীয় বন্দি হয়ে আছেন। আমরা কি তাঁদের জন্য কিছুই করতে পারি না? নাকি তাঁদের ভাগ্যেও সর্বজিতের পরিণতি অপেক্ষা করে আছে: মন্ত্রীদের কাছে পিটিশন পাঠানো, হাই কমিশনারকে বিশেষ আবেদন জানানো আর তার পরে পাকিস্তানের জেলে সংঘবদ্ধ, সুপরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হওয়া।
আরও চোখের জল (সত্যিকারের এবং গ্লিসারিন মিশ্রিত) আর আরও মোমবাতি মিছিল। |