ক’দিন আগে অবধিও ধরে রেখেছিলেন আশাটা। দলবীর কৌর স্বপ্ন দেখতেন, ভাই এক দিন ফিরবে। বেঁচে থাকতে নিশ্চয়ই তিনি বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন ভাইকে।
ভাই ফিরলেন। বাক্সবন্দি, নিষ্প্রাণ। সলমন খান টুইটারে লিখেছেন, “অবশেষে মুক্তি পেলেন সর্বজিৎ।”
পাকিস্তানের জেলে নিহত সবর্র্জিৎ সিংহের বোন দলবীরের মন আজ আর কোনও রকম বাধা মানেনি। দলবীর আজ খোলাখুলি পাক সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। অভিযোগ করেছেন, “পাকিস্তানে নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই সর্বজিৎকে খুন করেছেন আসিফ আলি জারদারি। পাকিস্তান এর আগে অটলবিহারী বাজপেয়ীর পিছনে ছুরি মেরেছিল। এ বার তারা মনমোহন সিংহের পিছনে ছুরি মারল।”
লাহৌরের কোট লাখপত জেলে ২৬ এপ্রিল ফাঁসির আসামি সর্বজিৎকে আক্রমণ করেছিল অন্য দুই কয়েদি আমের আফতাব ও মুদাস্সর। তারাও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। ইঁট দিয়ে সর্বজিতের মাথায় আঘাত করা হয়। জিন্না হাসপাতালে গত কয়েক দিন ধরে কোমায় ছিলেন তিনি। কাল মাঝরাতের সামান্য পরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। আজ এক বিবৃতিতে পাক সরকার জানিয়েছে, ঘটনাটি ‘অত্যন্ত দুঃখজনক।’ সর্বজিৎকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই করা হয়েছিল। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হল না।
কেন সর্বজিতের উপরে হামলা হল? আমের ও মুদাস্সর পুলিশকে জানিয়েছে, ভারতীয় চর সর্বজিৎ পাকিস্তানের মাটিতে বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো অপরাধে জড়িত ছিলেন। তাই সর্বজিৎকে ঘৃণা করতেন তাঁরা। কিন্তু এত বছর পরে হঠাৎ তাদের ঘৃণা উপছে পড়ল কেন? সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি ওই দুই কয়েদি। কোট লাখপতের প্রাক্তন ভারতীয় বন্দিরা জানিয়েছেন, পাকিস্তানে মাঝে মাঝেই ভারতীয় কয়েদিদের উপরে নানাবিধ হামলা চালানো হত। আর তার জন্য পাক জেলের অন্য বন্দিদেরই ব্যবহার করা হত। সুতরাং পাক নির্বাচনের প্রাক্কালে সর্বজিৎকে ফাঁসি না দিয়ে অন্য পথে সরিয়ে দেওয়া হল বলে সন্দেহ দলবীর-সহ অনেক শিবিরেই। বিশেষত ভারত কসাব এবং আফজলকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পরে সবর্র্জিৎকে সরানোর জন্য চাপ আরও বেড়েছিল বলে কারও কারও মত। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সর্বজিৎকে উপযুক্ত নিরাপত্তা দিতে না পারায় কোট লাখপতের কোনও অফিসার বা কর্মীর বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। |
হাসপাতাল থেকে বার করা হচ্ছে সর্বজিতের দেহ। বৃহস্পতিবার। ছবি: রয়টার্স |
পঞ্জাবের ভিখিউইন্দ গ্রামের বাসিন্দা সর্বজিতের পরিবার বরাবরই দাবি করে এসেছে, সর্বজিৎ আদৌ গুপ্তচর নন। ভুল করে সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও অপরাধ নেই তাঁর। পরিচয় বিভ্রাট ঘটায় তাঁকে বোমা বিস্ফোরণের মামলায় অভিযুক্ত করেছে পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান আদালত বরাবর সর্বজিৎকে চর বলেই রায় দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের তরফে সর্বজিতের মুক্তির অনুরোধ জানিয়ে আসা হয়েছে।
তাই নিয়ে নানা চাপানউতোর-টানাপোড়েন চলেছে। ভারতীয় বন্দি কাশ্মীর সিংহ মুক্তি পেয়েছেন। সর্বজিৎ পাননি। মাঝে এক বার নাম বিভ্রাটে ভারতের আর এক বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার সময় ভুল করে সর্বজিতের নাম প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে। সর্বজিতের পরিবার তার পরেও দমেনি। আশা ছাড়েনি। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
সর্বজিতের মুক্তি নিয়ে দীর্ঘ দিন সক্রিয় ছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন মন্ত্রী ও মানবাধিকার কর্মী আনসার বার্নি। আজ সেই বার্নির বিরুদ্ধেও চাঞ্চল্যকর অভিযোগ এনেছেন দলবীর। তাঁর দাবি, বার্নি ২৫ কোটি টাকা চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, সকালে এই টাকা দিলে বিকেলে সর্বজিৎ মুক্তি পাবেন। পরে সেই দাবি দু’কোটিতে নেমেছিল।
বার্নি অবশ্য সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। ভারত সরকারও সর্বজিতের বিষয়ে ঠিক মতো উদ্যোগী হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন দলবীর। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের মতে, সর্বজিৎকে ভারতে ফিরিয়ে আনার সব চেষ্টাই করেছিল কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী, বিদেশ মন্ত্রক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক স্তরে এই বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু সফল হওয়া গেল না। সর্বজিতের দেহ ফিরিয়ে আনার বিষয়েও এ দিন সকাল থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা হয় কেন্দ্রের। বিকেলে তাঁর দেহ লাহৌর থেকে বিশেষ বিমানে অমৃতসরে আনা হয়।
সর্বজিতের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই ভিখিউইন্দে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পরে দিল্লিতে ছিলেন সর্বজিতের পরিবার। এ দিন দুপুরে তাঁদের কপ্টারে ভিখিউইন্দে আনা হয়। সকাল থেকেই সর্বজিতের বাড়িতে জমা হচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কপ্টার থেকে নামার পরে দলবীরদের সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যায় জনতা। দলবীররা চান, ভারত সবর্র্জিৎকে ‘শহিদে’র অ্যাখ্যা দিক। তা নিয়ে অবশ্য এখনই সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন শিন্দে। কিন্তু পঞ্জাবে সবর্র্জিৎ শহিদের সম্মানই পাচ্ছেন। ভিখিউইন্দে কাল পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর সৎকার হবে বলে জানিয়েছেন পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদল।
সর্বজিতের খুনিদের শাস্তি চেয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সাবির শাহ-ও। তাঁর বক্তব্য, “পাকিস্তানের উচিত সর্বজিতের খুনিদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া।” |