|
|
|
|
ভোটে কর্নাটক |
ডুবন্ত নৌকার সওয়ার হয়েও
কুর্নিশ পেলেন মোদী
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • বেঙ্গালুরু |
|
|
ততক্ষণে কান লাল হয়ে গিয়েছে অনন্ত কুমারের!
এই বেঙ্গালুরু তাঁর কর্মভূমি। প্রায় দু’দশকের সাংসদ। ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে বেশ কয়েক বার কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতেও বসতে চেয়েছিলেন। এখন বছর গড়ালে লোকসভায় ফের এই জনতার দরবারেই হাত পাততে হবে। কিন্তু এ কী? নিজের ভোটাররাই আর তাঁর কথা শুনতে চান না!
মাইকের সামনে যে-ই এসেছেন, জনতা দু’হাত নাড়িয়ে বলছে, ‘না-না-না’। আর চিৎকার করছেন ‘মোদী-মোদী-মোদী’। রীতিমতো বেইজ্জত হয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলছেন। কিন্তু করবেন কী? মঞ্চে তখন সবে নরেন্দ্র মোদী ঢুকেছেন। কর্নাটকের প্রথম সভা। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। তাতে কী? হাজার কুড়ি জনতা চায়, ঝড় উঠুক। মোদী-ঝড়। ওলট-পালট করে দিক সব কিছু। এ রাজ্যটা হাতছাড়া হতে চলেছে। শেষ ভরসা একজনই। নরেন্দ্র মোদী। মোদী ইশারা করছেন অনন্ত কুমারকে, ‘বলে যাও।’ কাঁচুমাচু মুখে অনন্ত কুমার ওই মাইকের সামনেই মোদীকে বললেন, “কী করে বলব? আমার কথা তো কেউ শুনতেই চাইছে না! সবাই মোদী-মোদী বলছে। আপনিই কিছু করুন।” পরিত্রাতার ভূমিকায় নামলেন স্বয়ং মোদীই। আসন ছেড়ে উঠে এলেন মাইকের সামনে। করতালিতে ফেটে পড়ল বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল কলেজ গ্রাউন্ড। কিন্তু না। মোদী তো মোদীই। বললেন, “শুনুন, আমি অনন্ত কুমার আর রাজ্যের ধীর-স্থির-শান্ত প্রকৃতির মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ শেট্টারের কথা শুনতে সেই আমদাবাদ থেকে উড়ে এসেছি। তাঁদের কথা শোনার পরেই আমি আপনাদের সামনে বলব। ততক্ষণ থাকব আপনাদের মধ্যে, যতক্ষণ না আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন।”
যেন জাদু! নিমেষেই চুপ হল অশান্ত জনতা। অনন্ত কুমার বললেন। বললেন শেট্টারও। তার পর মোদীর পালা। এক ঘণ্টার বক্তৃতায় সত্যিই ঝড় তুললেন। বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করলেন কর্নাটক ভোটের এজেন্ডা। টিপু সুলতানের রাজ্যের হাঁড়ির খবর বিলক্ষণ জানেন মোদী। গত পাঁচ বছরে বিজেপি শাসনেই একের পর এক দুর্নীতি, ঘন ঘন মুখ্যমন্ত্রী বদল, আর সর্বোপরি ইয়েদুরাপ্পা বিদায়ের পর লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের সমর্থন হারানোর আশঙ্কা। জনতা ক্ষুব্ধ, রুষ্ট, বীতশ্রদ্ধ। বিজেপির কেন্দ্রীয় সংগঠনের সবথেকে প্রবীণ সাধারণ সম্পাদক অনন্ত কুমারের কথা শুনতে না চাওয়া তো তা-ও ছোট ঘটনা। মহল্লায় মহল্লায় বিজেপির বিধায়ক ভোট চাইতে এলে মুখের উপর দরজাও বন্ধ করে দিচ্ছে জনতা! সে কারণে ডুবন্ত নৌকায় সওয়ার হতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না মোদী। কিন্তু কর্নাটক থেকে রীতিমতো ‘এসওএস’ পাঠানো হয়েছে। সমর্থক-কর্মী-নেতারা একসুরে বলেছেন, ‘একবারটি আসুন। আমাদের বাঁচান।’ অগত্যা! ঝুঁকি নিয়েও আসতেই হল মোদীকে।
ঝুঁকি? কারণ, একটি বা দু’টি সভা করেই কর্নাটকের ভোটের ভোল বদলে দিতে পারবেন মোদী, এমনটা বুক ঠুকে কেউ-ই বলতে পারছেন না। আর তা না হলে কংগ্রেস দিল্লিতে প্রচার করবে, মোদী-জাদু গুজরাতের বাইরে অচল! দিল্লি তো দূর অস্ত্! কর্নাটকের নির্বাচন নিছক অন্য পাঁচটি বিধানসভা নির্বাচনের মতো নয়। লোকসভা ভোটের কাউন্টডাউন ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তার আগে যে ক’টি রাজ্যে বিধানসভা ভোট, তার প্রথমটি হল কর্নাটক। সব রাজ্যের ভোটেই চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, দিল্লির কুর্সি দখলের পথে কতটা এগোলেন কংগ্রেস ও বিজেপির দুই সেনাপতি রাহুল গাঁধী ও নরেন্দ্র মোদী। কর্নাটকের লড়াই আর শুধু রাজ্যের নেতাদের নয়। দিল্লির মুখ চেয়ে লড়ছেন এই দু’জনে। রাজ্যে যে জুটির লড়াইয়ের চলতি নাম ‘নমো-রাগা’।
গত পাঁচ বছরে এ রাজ্যে বিজেপি যে অস্থিরতা তৈরি করেছে, তাতে খুব বেশি কসরত করতে হচ্ছে না রাহুল গাঁধীকে। বিজেপি-বিরোধী হাওয়ায় ভর করে রাহুলের ভরসা রাজ্যের সংখ্যালঘু, দলিত, তফসিলি জাতি-উপজাতি ভোট আর অবশ্যই ইয়েদুরাপ্পা। দুর্বল বিজেপিকে আরও ঘা দিয়ে ইয়েদুরাপ্পা তাদের কাবু করবেন, এমনটাই আশা কংগ্রেসের। এক সময় ইতিবাচক রাজনীতির কথা বলেও রাহুল তাই কর্নাটকে বিজেপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারেই আস্থা রাখছেন। কেন্দ্রের দুর্নীতি নিয়ে যে রাহুলের মত এখনও সে ভাবে সামনে আসেনি, সেই রাহুলই কর্নাটকের হাভেরির সভাতে এসে বললেন, “দুর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ড গড়েছে বিজেপি সরকার!” তাঁর চেনা ছন্দে ব্যারিকেড টপকে পৌঁছেও যাচ্ছেন জনতার ভিড়ে। জনতার মনে ছাপও পড়ছে তাতে। ম্যাঙ্গালোর আর চিকমাগালুরে এসে সনিয়া গাঁধী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন স্থায়ী ও মজবুত সরকারের। সেই চিকমাগালুর, যেখান থেকে এক সময় সাংসদ হয়ে তাঁর শাশুড়ি ইন্দিরা গাঁধীর রাজনৈতিক উত্থান হয়েছিল। ভোটারদের সঙ্গে হৃদয় জুড়তে চিরকূটে লিখে আনছেন কন্নড় ভাষায় দু’তিনটি লাইনও। ওই দু’লাইনেই মজছে জনতা।
কিন্তু শাশুড়ির পুরনো নির্বাচনী কেন্দ্র মনে পড়লেও কর্নাটকের নিজের পুরনো কেন্দ্রের ত্রিসীমানায় ঘেঁষছেন না সনিয়া। রাহুলও না। ১৯৯৯ সালে যে বল্লারি থেকে সাংসদ হয়েছিলেন সনিয়া, সেখান থেকে কংগ্রেস টিকিটে লড়ছেন অনিল লাড। বল্লারির রেড্ডি ভাইদের সঙ্গে লাডের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিল লোকায়ুক্ত রিপোর্টে। রাহুলের সফর চূড়ান্তও হয়। কিন্তু বিতর্ক এড়াতে বাতিল হয় শেষ মুহূর্তে। মেপে পা ফেলছে গাঁধী পরিবারও। অনিল লাড আফশোস করে বললেন, “কী কাণ্ড দেখুন তো! এসপিজি তন্ন তন্ন করে ঘুরে গেল। পুলিশ কুকুর শুঁকে গেল। তার পরেও রাহুলজি এলেন না! বলছে না কি নিরাপত্তার কারণ!” আসল কারণ কী? কংগ্রেসের এক নেতা বললেন, “যখন বিজেপির দুর্নীতি নিয়ে রাহুল এত সরব হচ্ছেন, তখন বল্লারিতে পা রাখেন কী করে?” রাহুলের বিড়ম্বনা এখানেই শেষ নয়। প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী ও কর্নাটকের প্রবীণ নেতা এস এম কৃষ্ণ প্রকাশ্যেই তোপ দাগছেন রাহুলের বিরুদ্ধে। বেঙ্গালুরুতে নিজের বাড়িতে বসে বলছেন, “অপরাধী, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, নেতার পরিবারের লোক, গত বার হেরে যাওয়া প্রার্থী সবাই তো টিকিট পেয়েছেন কংগ্রেসের! যে রাহুল গাঁধী আর ক’দিন পর দেশের নেতৃত্ব দেবেন, তাঁর কি উচিত ছিল না শক্ত হাতে এগুলি মোকাবিলা করা?”
কংগ্রেস যতই কর্নাটকে সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখুক, দলের নেতাদের কোন্দলে এখনও পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর নামও ঘোষণা করতে পারেনি! আর কর্নাটকে প্রচারে এসে সেখানেই চেপে ধরেছেন মোদী। বলছেন, “হাত তো দেখাচ্ছ, মুখটাও দেখাও! তা না হলে এই ‘হাত’ (কংগ্রেসের প্রতীক চিহ্ন) বাঁচাবে না ডোবাবে, তার গ্যারান্টি কে দেবে?” রাহুল-সনিয়া-মনমোহন সিংহকে ক্রমাগত আক্রমণ করে মোদী কর্নাটকের নির্বাচনের মোড়টি ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন দিল্লির নিরিখে। যাতে স্থানীয় অসন্তোষ ভুলে দলের কর্মী-সমর্থকদের মনোবল বাড়ে, আসন বাড়ে আর তাতে যদি ফের গদি দখল করা যায়। আকুল আবেদনও করলেন, “রাজ্যে বিজেপির মধ্যে অস্থিরতা থাকলেও সরকারের কাজে তার প্রভাব পড়েনি। জনতা সব ভুল মাফ করে আর একটি সুযোগ দিন।” মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ শেট্টারের পিছনে যথাসম্ভব দাঁড়িয়ে মোদী গোটা নির্বাচনকে কার্যতই ‘নমো-রাগা’য় পরিণত করার চেষ্টা করলেন।
কর্নাটকের যুদ্ধে বাজি ধরেছেন দু’জনেই। কে জিতবেন, সেটা জানার জন্য অপেক্ষা আর মাত্র আট দিনের। |
|
|
|
|
|