মহিলা ব্রিগেডের পরে পুলিশ ব্রিগেড।
সংস্থার চার দেওয়ালের ভিতরের কাজ সামলাতে তিনি যে মহিলা ব্রিগেডের উপরেই অধিক নির্ভরশীল ছিলেন, সে কথা ইতিমধ্যে জেরায় কবুল করেছেন সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। কিন্তু বাইরের কাজকর্ম সামলাতে যে মোটা টাকা দিয়ে একাধিক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারদের পুষতেন, তদন্তকারীদের তা জানা ছিল না। এ বার সেটাও প্রকাশ্যে এল।
তদন্তকারীরা জেনেছেন, ডিআইজি বা আইজি হিসেবে অবসর নেওয়া পুলিশের জনা তিন-চার প্রাক্তন কর্তা সারদা গোষ্ঠীতে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন। মোটা বেতন পেতেন তাঁরা। এর বাইরে কলকাতা ও রাজ্য পুলিশেরও ৩৫-৩৬ জন নিচুতলার কর্মীকে সুদীপ্ত নিজের সংস্থায় চাকরি দিয়েছিলেন বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। |
বছর তিনেক আগে সারদা সংস্থার একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন কলকাতার
বর্তমান পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। ছবি এবিপি আনন্দের সৌজন্যে। |
পুলিশ-সূত্রের খবর, সুদীপ্তের ‘পুলিশ ব্রিগেডে’ ছিলেন কলকাতার তিন জন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। তাঁদের দু’জনের এলএলবি ডিগ্রি আছে। ব্রিগেডে ছিলেন সিআইডি-রও দুই অবসরপ্রাপ্ত ডিএসপি। তদন্তের স্বার্থে ওঁদের ডেকে পাঠানো হতে পারে বলে মঙ্গলবার ইঙ্গিত দিয়েছেন মহাকরণের এক পুলিশ-কর্তা। এ দিকে পুলিশ-সূত্রের খবর, সারদা-মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এ দিন সজ্জন অগ্রবাল এবং সন্দীপ অগ্রবাল নামে দুই ব্যবসায়ীকে দফায়-দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দারা। অভিযোগ, এঁদের হাত দিয়েই বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার কয়েক জন অফিসারের কাছে ‘উপহার’ পাঠানো হতো। সুদীপ্তকে জেরা করে এমনই তথ্য জানা গিয়েছিল।
প্রাক্তন পুলিশ অফিসারেরা সারদায় কী কাজ করতেন? কেনই বা সারদা-মালিক তাঁদের মোটা বেতনে পুষতেন? এক পুলিশ-কর্তার ব্যাখ্যা,গত বছর একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল সারদা। তাতে বলা হয়েছিল: নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালাতে ও প্রয়োজনে আইনি পরামর্শ দিতে অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার চাই। তাতে অবশ্য বেতনের কোনও উল্লেখ ছিল না। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সারদায় কর্মরত পদস্থ পুলিশ-কর্তাদের উপরেই অধঃস্তন কর্মী জোগাড় করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুদীপ্ত। সেই সূত্রেই একের পর এক প্রাক্তন পুলিশ অফিসার সংস্থায় যোগ দেন। এখন মহাকরণের ওই পুলিশ-কর্তার ইঙ্গিত, সারদার সঙ্গে যুক্ত প্রাক্তন পুলিশ-কর্মীরা চাকরি জীবনের প্রভাব খাটিয়ে বেআইনি কাজ করেছেন এমন প্রমাণ মিললে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সারদা-ব্রিগেডে এক জন প্রাক্তন পদস্থ পুলিশ-কর্তা চাকরিজীবনে মাসে লাখ টাকার মতো বেতন পেলেও সারদায় পেতেন মাসে ১০ লক্ষ! পুলিশের দাবি, জেরায় সুদীপ্ত বলেছেন, পুলিশ-ব্রিগেডের পিছনে মাসে অন্তত কোটি টাকা ঢালতেন। তাঁর বক্তব্য যাচাই করা হচ্ছে।
পাশাপাশি যে সব নেতার মদতে সুদীপ্ত সেনের ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল বলে অভিযোগ, তাঁদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশ-সূত্রের খবর: সন্দেহ-তালিকায় শাসক ও বিরোধী দলের নেতারা আছেন। পুলিশ বলছে, জেরায় সুদীপ্ত দাবি করেছেন, ওই সব রাজনৈতিক নেতার পিছনে তাঁকে মোটা টাকা গুনতে হতো। ওই নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে সুদীপ্তের সম্পর্ক কেমন ছিল, তা জানতে সারদার অন্যতম ডিরেক্টর দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের গাড়ির চালক রতন ঠাকুরকে লাগাতার জেরা করেছে পুলিশ। পুলিশকে রতন জানিয়েছেন, দেবযানী তাঁর হাত দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার কাছে নানা দামি উপহার ও প্যাকেটবন্দি জিনিসপত্র পাঠাতেন। তবে প্যাকেটে কী থাকত, তা কোনও দিন তিনি খুলে দেখেননি।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সুদীপ্ত সেনের দুই স্ত্রী মধুমিতা এবং পিয়ালিদেবীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছে। অ্যাকাউন্টগুলোয় নগদ প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা এবং বহুমূল্য অলঙ্কার মিলেছে। পুলিশের বক্তব্য: জেরায় সুদীপ্ত জানিয়েছেন, তাঁর অন্য সব ব্যবসা খানিকটা অলাভজনক হতে শুরু করলেও সারদা এক্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড লাভের মুখ দেখেছিল। গোয়েন্দারা জেনেছেন, ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার একাধিক দেশে নানা সামগ্রী রফতানি করত সারদা। সুদীপ্তের দাবি অনুযায়ী, চামড়ার সামগ্রী পাঠানো হতো দুবাইয়ে, ইউরোপে বস্ত্র। দুবাই-সহ আরব মুলুকের কয়েকটি দেশে রিয়েল এস্টেটের কারবারে নামারও পরিকল্পনা ছিল সুদীপ্তের।
পুলিশের দাবি: মামলা শুরুর পরের সাত দিন, অর্থাৎ, ১৭ থেকে ২৪ এপ্রিলের মধ্যে সফ্টওয়্যারের ত্রুটির সুযোগে প্রায় ১০ হাজার ভুয়ো পলিসি তৈরি করা হয়েছিল সারদার ব্যবসায়। অধিকাংশই ভিন রাজ্যে। গোয়েন্দাদের ধারণা, সারদা গোষ্ঠীকে বিপাকে ফেলতে এজেন্টদেরই একটা অংশ সেগুলো বানিয়েছে, যার অঙ্ক প্রায় দু’কোটি টাকা। তদন্তকারীদের দাবি: সফ্টওয়্যারের ত্রুটির কথা সুদীপ্ত নিজেও জানতেন। সারদা-কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জেনেছে, ওই সফ্টওয়্যার নিয়ে সংস্থার নিজস্ব বৈঠকে আপত্তিও তুলেছিলেন একাধিক সারদা-কর্তা। তা ধোপে টেকেনি। এক পুলিশ-কর্তা বলেন, “সারদার মূল সার্ভারের তথ্য জানতে কেন্দ্রীয় সরকার মারফত আমেরিকার কাছে আবেদন জানানো হবে।” পুলিশ জানিয়েছে, বস্টনস্থিত মূল সার্ভার ব্যবহার বাবদ সারদা গোষ্ঠীকে মাসে ৪৪ হাজার ডলার ভাড়া গুনতে হতো।
এ দিকে পুলিশ-সূত্রের খবর: সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে আমানতকারী ও এজেন্ট মিলিয়ে তিন জন আত্মহত্যা করেছেন। এবং সেই সূত্রে সারদা-কর্তার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনাদানের মামলাও দায়ের হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ বাদ দিলে ইতিমধ্যে অসমে সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। এ দিন ওড়িশা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ‘আর্থিক দুর্নীতি দমন’ শাখাও মামলা রুজু করেছে। তাদের তদন্তকারীরা এ দিন বালেশ্বরে গিয়ে সারদার কয়েক জন আমানতকারীর সঙ্গে কথা বলেছেন। নথিবদ্ধ করেছেন তাঁদের বয়ান। |