সারদা -কেলেঙ্কারির জের
ঝুঁকি এড়াতে টাকা তুলতে চান লগ্নিকারীরা
মানত আর জমা দিতে চাইছেন না কেউ। উল্টে এতদিন ধরে যা জমা দিয়েছিলেন, তা তুলে নিতে ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থাগুলির দফতরে লম্বা লাইন পড়ছে আমানতকারীদের। তাঁদের বক্তব্য, সুদ চাই না, যতটা টাকা জমা দিয়েছি, ততটাই ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। একযোগে সমস্ত আমানতকারী টাকা ফেরত চাওয়ায় মহা সমস্যায় পড়েছে সংস্থাগুলি। মাঝপথে টাকা ফেরতের নিয়ম নেই বলে ‘রেহাই’ পেতে চাইছে তারা। কোথাও তা বোঝাতে গিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ছেন সংস্থার কর্তারা।
মেদিনীপুরে রোজ ভ্যালীর অফিসের সামনে আমানতকারীদের ভিড়। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
রোজ ভ্যালীর মতো কিছু সংস্থা আবার জমা টাকা থেকে কিছুটা কেটে ফেরত দিচ্ছেন আমানতকারীদের। এমনকী এই বাজারেও কাঁথি বা ঝাড়গ্রাম অফিসে রোজ ভ্যালীর আমানত সংগ্রহ হচ্ছে বলে দাবি ম্যানেজারদের। রোজ ভ্যালীর ঘাটাল শাখার ম্যানেজার দেবাশিস মাইতি বলেন, “আমরা প্রতিদিনই শতাধিক আমানতকারীকে টাকা দিয়ে দিচ্ছি। ব্যবসা আগের মতো আর হচ্ছে না। তবে অনেকে টাকা রেখেও দিচ্ছেন।” রোজ ভ্যালীর ঝাড়গ্রাম শাখায় সোমবার ঠা -ঠা রোদের মধ্যেই হাজার খানেক মানুষের লম্বা লাইন ছিল। লাইনে থাকা বিনপুরের দহিজুড়ির বাসিন্দা পেশায় দিনমজুর আলমণি হাঁসদা, কার্তিক মাণ্ডিরা বললেন, “সারদায় টাকা রেখে পরিচিতজনকে সর্বস্বান্ত হতে দেখার পর আর ঝুঁকি নিতে চাই না। তাই মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই টাকা তুলতে এসেছি।” রোজ ভ্যালীর ঝাড়গ্রাম শাখার ম্যানেজার গোপীরঞ্জন দত্ত বললেন, “আবেদন করার এক থেকে দু’দিনের মধ্যে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকদের মধ্যে যেমন টাকা তোলার হিড়িক পড়ে গিয়েছে, তেমনই অনেক গ্রাহক কিন্তু টাকা জমাও দিচ্ছেন।” মেদিনীপুর শহরের স্টেশন রোডে রোজ ভ্যালীর অফিসে আমানতকারীদের ভিড়েই মিশে ছিলেন এজেন্ট সোমজিৎ মাহাতো। তাঁর কথায়, “যাঁদের পলিসি করেছিলাম, তাঁরা এখন টাকা ফেরত দেওয়ার চাপ দিচ্ছেন। কেউই অপেক্ষা করতে রাজি নন। তাই অফিসে এসেছি।” এরই মধ্যে কিছু আমানতকারীদের কাছ থেকে পলিসি কিনে নিচ্ছেন এজেন্টরা। পূর্ব মেদিনীপুরের চৈতন্যপুরে রোজ ভ্যালীর এক গ্রাহক অচিন্ত্য হাতি বলেন, “আমি পাঁচ বছরের জন্য পাঁচশো টাকা করে মাসে দিতাম। মাস পর মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ৫২ হাজার ৭০০ টাকা পেতাম। ভরসা রাখতে না পেরে রোজ ভ্যালীর অফিসে টাকা চাইতে গেলে এক জন এজেন্টই ২৬ হাজার টাকা দিয়ে পলিসিটা কিনে নিলেন।” তমলুক শহরে রোজ ভ্যালীর অফিসে এসেছিলেন নন্দকুমারের কুমোরচক গ্রামের যুবক সুদীপ মণ্ডল। তিনি বলেন, “প্রতি মাসে ৫০০ টাকা জমা দিতাম। ২৫ মাস জমা দিয়েছি। পাঁচ বছর চালানোর কথা ছিল। তবে, আর নয়। টাকা ফেরতের আবেদনপত্র দিতে এসেছি।” কাঁথি শহরে রোজ ভ্যালীতে সোমবার চারশোরও বেশি আমানতকারী মেয়াদ অন্তের আগেই টাকা তুলে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে ম্যানেজার সুজয় পণ্ডা জানিয়েছেন। সুজয়বাবু জানান, এ দিন লক্ষ ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে আমানতকারীদের। অন্য দিকে লক্ষ ৫০ হাজার টাকা আমানত হিসেবে কাঁথি শাখাতে জমা পড়েছে।
রোজ ভ্যালী ছাড়া অন্য সংস্থাগুলি মেয়াদ শেষের আগে টাকা ফেরত দিতে না চাওয়ায় গোলমাল হচ্ছে। কলকাতা ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি সংস্থার অফিস রয়েছে খড়্গপুর শহরের ইন্দায়। সোমবার দুপুরে এই অফিসেও আমানতকারীদের ভিড় ছিল। মেয়াদ শেষের আগেই টাকা ফেরতের দাবি করেন আমানতকারীরা। পাশে এসে দাঁড়ান ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়। আমানতকারীদের সঙ্গে সংস্থার কর্তাদের বচসাও হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ। কাউন্সিলরের কথায়, “প্রয়োজনে ধর্নায় বসব। গরিব মানুষের টাকা যে করেই হোক ফেরত দিতে হবে।” তবে, অনভিপ্রেত কোনও ঘটনা ঘটেনি। জেলা পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরীর বক্তব্য, “কিছু অফিসে আমানতকারীরা গিয়ে জমানো টাকা ফেরত চেয়েছেন বলে শুনেছি। পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হয়েছে।”
ঘাটাল মহকুমায় প্রায় ৬১টি ভুঁইফোঁড় সংস্থা। দিন ঘাটাল থানার সেল্ফ ট্রাস্ট লিমিটেড এবং দাসপুর থানায় রিয়েল বন্ড সংস্থা দু’টি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এজেন্ট আমানতকারীরা বিক্ষোভ দেখান। লিখিত ভাবে দুই থানাতেই দুই সংস্থার কর্মকর্তাদের নামে অভিযোগ জানান আমানতকারীরা। পুলিশ সূত্রের খবর, রাজ্য সরকারের নির্দেশ পেয়ে মহকুমার প্রতিটি থানা ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির তালিকা তৈরি করেছে। দেখা যাচ্ছে ঘাটাল থানায় ৩৫টি, চন্দ্রকোনা থানায় ১৫টি এবং দাসপুর থানায় ১১টি এই ধরনের সংস্থার অফিস রয়েছে। প্রতিটির সামনেই আমানতকারীদের লম্বা লাইন। এদিনই শতাধিক আমানতকারী ভিড় জমান এটিএম গ্রুপের অফিসে। এই সংস্থাও এখনও টাকা না দিলেও আশ্বাস দিয়েছেন ফেরতের। কী করা উচিত তা নিয়ে দোলাচলে ছোটখাটো সংস্থাগুলি।
ঝাড়গ্রাম শহরের মেন রোডে আইকোর এটিএম গ্রুপের অফিস রয়েছে একই ভবনে। গত শনিবার আইকোর -এর ঝাড়গ্রাম শাখায় টাকা ফেরত না পেয়ে ভাঙচুর চালান কিছু গ্রাহক। আইকোর -এর ঝাড়গ্রাম শাখার ম্যানেজার সঞ্জয় হালদার বলেন, “মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে আমানত ফেরত দেওয়ার কোনও নির্দেশ নেই। কিন্তু গ্রাহকেরা সে কথা শুনতে চাইছেন না। তারা এসে গোলমাল করছেন। পুলিশকে জানিয়েছি।” এটিএম গ্রুপের অফিসও শুনশান ছিল। ম্যানেজারকে পাওয়া গেল না। এক কর্মী বললেন, “আমাদের এখানে এখনও গ্রাহক -বিক্ষোভ হয়নি। ঝাড়গ্রামে মাত্র তিন বছর সংস্থার কাজকর্ম হচ্ছে। আমাদের ব্যবসার পরিধি এখানে তুলনামূলক ভাবে কম।” এ দিন দুপুরে সারদা গোষ্ঠীর ঝাড়গ্রাম শাখার এজেন্টরা ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে স্মারকলিপি দেন। এজেন্টদের বক্তব্য, টাকা ফেরতের জন্য আমানতকারীরা এজেন্টদের উপর মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছেন। এজেন্টরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সুদীপ্ত সেনকেই আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে বলে স্মারকলিপিতে দাবি করেছেন এজেন্টরা।
দিকে, সারদা সহ -অন্য ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলি বাম আমলেই গজিয়ে উঠেছিল অভিযোগ তুলে সোমবার হলদিয়ার ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের সিটি সেন্টারে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল। দিনই হলদিয়ার মঞ্জুশ্রীর কাছে এইচপিএল লিঙ্ক রোডে ‘রিয়্যাল সানরাইজ কেমটেক লিমিটেড’ নামে একটি ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থায় টাকা ফেরতের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান আমানতকারীরা। পূর্ব মেদিনীপুরে খাদির পোশাক ব্যবসার নামে টাকা তুলত হাম প্রজেক্ট লিমিটেড। সম্প্রতি এর অফিসগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সংস্থার এজেন্ট তমলুকের নারায়ণদাঁড়ির বাসিন্দা লক্ষ্মীকান্ত মাইতি রবিবার তমলুক থানায় কর্তৃপক্ষের নামে নানা অভিযোগ করেছেন। যদিও পুলিশের বক্তব্য, ওই ব্যক্তিই বহু লোকের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রচুর টাকা তুলেছেন। এখন পিঠ বাঁচাতে এই সব অভিযোগ করছেন তিনি।
দিন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সহ -সভাধিপতি মামুদ হোসেন জেলাশাসককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, জেলায় ২৮৩ ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা তুলেছে। আমানতকারীদের টাকা ফেরতের জন্য সংস্থাগুলির অফিসে এখনই প্রশাসনিক ভাবে পদক্ষেপ করার দাবি জানিয়েছেন মামুদ হোসেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.