মাসকয়েক আগে দিল্লির গণধর্ষণে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় সরকার মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের কঠোরতর আইন প্রণয়ন করে। ভাবা হয়েছিল, এর ফলে এ ধরনের অপরাধ কমবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই নৃশংস অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। আরও ভয়ের কথা, দেশ তোলপাড় হয়েছিল যেখানকার ঘটনা নিয়ে, সেখানেই অপরাধের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি, অত্যাচার নৃশংসতর এবং গুড়িয়াদেরও রেহাই নেই!
সরকার দিশেহারা। কী ভাবে এই জঘন্যতম অপরাধ দমন করা যাবে?
ইতিহাসে দেখা যায় মৃত্যুদণ্ড কোনও দিনই অপরাধ কমাতে পারেনি। হয়তো কাম ও ক্রোধ দুটি রিপুই এত শক্তিশালী যে, এর বশীভূত মানুষের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্বন্ধে ভাবার ক্ষমতা লোপ পায়। ধর্ষণ সাধারণত হয় উত্তেজক কাম বা প্রতিহিংসার ক্রোধবশত। বিকৃত কাম আরও ভয়াবহ। অষ্টাদশ শতকে আমেরিকা ও ইউরোপে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেখার জন্য সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হত। এই ফাঁসিদর্শন অবশ্যই মানুষ উপভোগ করত।
কয়েক শতক বাদে মানুষের প্রবৃত্তি আরও নিম্নগামী। বস্তুত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাত্সিদের অত্যাচারের চেয়ে আজকের পাঁচ বছরের শিশুর উপর অত্যাচারের প্রক্রিয়া ভয়াবহতর।
অতএব কঠোরতর শাস্তির ভয় দেখিয়ে অপরাধ দমনের চেয়ে অপরাধের কারণ খুঁজে বের করে সেই পরিবেশ বা পরিস্থিতি পালটানো যায় কি না, দেখা দরকার।
বহু কাল ধরে বেশির ভাগ দেশেই নারী সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু আজ টেলিভিশন, সিনেমা, খবরের কাগজ, পত্রিকা ও বিজ্ঞাপনে নারীদেহের নির্লজ্জ অবাধ প্রদর্শনে নারীর ভাবমূর্তি ভীষণ ভাবে অবনমিত। তারই প্রতিফলন ঘটছে সমাজে, জীবনযাত্রায় ব্যাপক ভাবে।
সিনেমায় স্বল্পবাস পরিহিতা নায়িকার যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ গানের সঙ্গে চটুল নাচ আজ শুধু সিনেমাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হোটেল, কলেজ ফেস্ট সর্বত্রই এগুলি জনপ্রিয় বিনোদন। প্রখ্যাত ধনীদের বিবাহের মতো অনুষ্ঠানে মুম্বইয়ের তারকারা স্বয়ং উপস্থিত হয়ে এই সব নৃত্য প্রদর্শন করেন। রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা দিবসেও আজ স্বল্পবাস পরিহিতাদের দিয়ে এই সব যৌন উত্তেজক নাচ পরিবেশন করা হয়। টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো থেকে আই পি এল-এর ককটেল স্বল্পবসনা সুন্দরীদের উদ্দাম দাপাদাপি ছাড়া আজকের বিনোদন অসম্পূর্ণ। চিয়ারলেস!
আজকাল অধিকাংশ খবরের কাগজের দুটি পৃষ্ঠা সংরক্ষিত থাকে লাস্যময়ীদের নানা বিভঙ্গের ছবি প্রদর্শনে। ছবির নীচের ক্যাপশনগুলি অবশ্যই নিরামিষ নয়। বিভিন্ন কাগজ ও মেয়েদের পত্রিকার একটি জনপ্রিয় বিভাগ রূপচর্চা। এই রূপচর্চা বেশির ভাগ সময়েই ‘ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের রূপচর্চা’ নয়, যৌন আবেদন ফুটিয়ে তোলার চর্চা। তাই এখন রূপ বিশেষজ্ঞদের সহজ সাজেশন: ‘এই শীতে লম্বা মোজা ও কম পোশাকে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলুন’। ‘বাবা জ্ঞান দিয়ো না’ টাইপের নীচে দীপিকা পাড়ুকোন, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া ও বিপাশা বসুর হট প্যান্টে পা ফাঁক করে দাঁড়ানোর ছবির পাশে সাংবাদিকদের বোল্ড উক্তি: ‘ছোট্ট প্যান্ট, একটু দুষ্টুমি’। মনে রাখতে হবে, আজকের কিশোরী, যারা দইয়ের ফোঁটা কপালে দিয়ে পরীক্ষা দিতে যায়, তাদেরও কিন্তু নিজেকে সাজানোর লক্ষ্য হয় ‘দুষ্টুমি’। ক্রমাগত এই ‘দুষ্টুমি’ দেখতে দেখতে কারও কারও মাথায় ‘নষ্টামি’র ইচ্ছে তো চাপতেই পারে। আজকের সাংবাদিকতার অভিধানে ‘বোল্ড’ হচ্ছেন পাওলি দাম দময়ন্তী সেন নন। এই ‘দুষ্টুমি’ ও ‘বোল্ডনেস’-এ কি রাশ টানার দরকার নেই?
বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে দেখছি, মেয়েদের প্রসাধন সামগ্রী থেকে পুরুষের অন্তর্বাস, মহিলাদের ব্যবহার্য থেকে জন্মনিরোধক সামগ্রী বিজ্ঞাপিত বস্তুর চেয়েও নারীর যৌন আবেদন প্রদর্শনই যেন ক্রমশ বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে! তার কারণ, জিনিস বিক্রয়ের এটাই সহজতম পন্থা। মেয়েরাও সানন্দে রীতিমত প্রশিক্ষণ নিয়ে এই ধরনের বিজ্ঞাপনে মডেলিং করেন।
এর প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী। যাঁরা বই পড়েন, গান শোনেন, বেড়াতে যান, তাঁদের সংখ্যা এখন কম। বেশির ভাগ মানুষের বিনোদন মানে সিনেমা, চব্বিশ ঘণ্টার টেলিভিশন (যাতে অনুষ্ঠানের থেকে বিজ্ঞাপন বেশি) ও খবরের কাগজ। অতএব নিজেদের অজান্তেই এই বিনোদনের কুফল ভীষণ ভাবে মজ্জাগত হচ্ছে জনসাধারণের। তাদের চোখে মেয়েরা আজ ‘নহ মাতা, নহ কন্যা’, শুধুই সুন্দরী রূপসী। অবচেতনে জন্ম নেয় বিকৃত কাম। সুযোগ পেলে যা জঘন্যতম অপরাধের দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে। তখন ক্ষণিক সুখই পাখির চোখ। ফাঁসির ভয় দূর অস্ত্।
সিনেমার নায়িকা, বিজ্ঞাপনের মডেল বা ক্রিকেটারের বান্ধবীর সাজের অনুকরণ করেন সাধারণ মেয়েরা। যাঁদের অনুকরণ করা হয়, তাঁরা বডিগার্ড নিয়ে বিএমডব্লিউ বা মার্সিডিজ চড়েন। যাঁরা অনুকরণ করেন তাঁদের কিন্তু ট্রামে-বাসে বা আলো-আঁধারিতে নির্জন রাস্তায় চলাফেরা করতে হয়। নিজেদের বিপদ তাঁরা নিজেরাই ডেকে আনছেন।
মেয়েরা যদি নিজেদের সম্মান রক্ষায় নিজেরা একটু সচেষ্ট হন, তা হলে বিপদ কিন্তু অনেকটাই এড়ানো যায়। আমরা ভল্টে গয়না রাখি, ব্যাঙ্কে টাকা রাখি, দরজায় একাধিক তালা লাগাই, জানালায় গ্রিল লাগাই। কিন্তু নিজের সম্মান রক্ষার জন্য কেন অপরের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল? প্রাতর্ভ্রমণে আমি গয়না পরি না বা যে রাস্তায় অনেক কুকুর আছে যাই না। অবশ্যই আমার গয়না পরে যে-কোনও রাস্তায় হাঁটার অধিকার আছে। কিন্তু চোর ও কুকুর আমার অধিকারের মর্যাদা না-দিলে সেটা হবে শুধুমাত্র আমারই অ্যাকসিডেন্ট!
খোলামেলা পোশাকে যে-কোনও সময়ে যে-কোনও জায়গায় যাওয়া ও যে-কোনও প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় বিপদের সম্ভাবনা বেশি। এটা নীতিশিক্ষা নয়, বাস্তববোধ মাত্র। প্রয়োজনে আজকের মেয়েদের দশভুজা হতে হয়। ভ্রান্তিবিলাসের সময় আছে কি?
শ্রীপর্ণা ঘোষ। কলকাতা-৫৪
|
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা (‘মেয়েদেরও বাথরুম পায়...’, ২৪-৩) প্রসঙ্গে বলা যায়, মেয়েদের শৌচাগারের জন্য আরও একটা স্বাধীনতা আন্দোলন দরকার। কর্মসূত্রে গত আট বছর শৌচাগার প্রকল্পে কাজ করার সুবাদে দেখেছি, সরকারি টাকা পর্যাপ্ত নয়, স্কুলে জায়গা অপ্রতুল, জলের সরবরাহ নেই, নর্দমা নেই, মেয়েদের দেওয়াল-দরজা ছাড়া শৌচাগার ইত্যাদি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্কুলে প্রতি ২৫টি মেয়ের এবং প্রতি ৫০টি ছেলের জন্য একটি করে শৌচাগার থাকবে। কিন্তু সরকার ৮০টি মেয়ে এবং ১২০টি ছেলের জন্য একটি শৌচাগারের টাকা দেয়। তাও গত ক’বছর ধরে প্রত্যেক স্কুলের শৌচাগার প্রকল্পের টাকা ২০,০০০ থেকে ৩৫,০০০ হয়েছে। আসলে, সমস্যাটা চিন্তাধারার। স্কুলের ছেলেমেয়েরা নির্বাচনে প্রভাব ফেলে না এবং সরকারকে সব স্কুলের কথা ভাবতে হয়। |
অনেক প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা একটি মাত্র টয়লেট দিয়ে কাজ চালান। এক অবস্থা কলকাতার স্কুলেও। পাশের হাইস্কুলে হয়তো বড় বাড়ি আছে, স্কুল নির্বাচনে বোমাবাজি হয়, কমিটি আছে, কিন্তু শৌচাগার নেই। কেউ ভাবেই না। নানা কারণে নবনির্মিত শৌচাগার ব্যবহার হয় না। যেমন, ছাত্রছাত্রীরা নোংরা করে ফেলবে! মেয়েদের জন্য আলাদা চেঞ্জ রুম বানিয়ে দেওয়ার পরেও যত্রতত্র ন্যাপকিন পড়ে থাকে, প্যানে পড়ে প্যানও জ্যাম হয়। ডাস্টবিন থাকলে উপচে পড়ে। পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নেই।
কলকাতা পুর এলাকাতেও অনেক স্কুলে আজও পানীয় জল পৌঁছায়নি। গ্রামের কথা বাদ দিলাম। জল ছাড়া কখনও শৌচাগার প্রকল্প সার্থক হয় না। বাচ্চারা জলই পায় না যখন, শৌচাগার পাবে কী করে? শিক্ষার অধিকার আইনের সমীক্ষা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ৩০ শতাংশ স্কুলে পানীয় জল নেই আর প্রতি ১০টিতে ৬টি স্কুলে মেয়েদের শৌচাগার নেই।
নিলয় মোদক। বাগুইআটি |