সম্পাদকীয় ১...
বিশ্বাসভঙ্গ
সাধারণ মানুষ হরেক কিসিমের পাপ করিয়া থাকে বটে, কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাইবার পাপটি সচরাচর করে না। মানুষ বিশ্বাস করিতে চাহে। সমাজবদ্ধ জীবে পরিণত হইবার প্রক্রিয়ায় চেনা প্রতিবেশের মানুষকে বিশ্বাস করিবার প্রবৃত্তিটি মানুষের মজ্জাগত হইয়াছে। বস্তুত, বিশ্বাস করিতে না পারিলে বাঁচিয়া থাকা দায় পরস্পরের প্রতি সর্ব ক্ষণ সন্দেহের চোখে তাকাইলে জীবন চলে না। পারস্পরিক বিশ্বাসই সমাজকে চালাইয়া লইয়া যায়, যে কোনও সমাজেই পারস্পরিক বিশ্বাস অপরিহার্য। আবার, সেই বিশ্বাসই বিপর্যয় ডাকিয়া আনিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে যেমন আনিয়াছে। সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক অনিয়ম যে দীর্ঘ কাল সাফল্যের সহিত চলিয়াছিল, তাহার মূলে রহিয়াছে এই বিশ্বাস। ছাপোষা মানুষ বিনিয়োগের বাজার বুঝেন না, পঞ্জি স্কিমের নাম পর্যন্ত শুনেন নাই। তাঁহারা প্রতিবেশীকে চিনিতেন, বিশ্বাস করিতেন। সারদা গোষ্ঠী সেই বিশ্বাসের চূড়ান্ত অপব্যবহার করিয়াছে। যে সব মানুষ এলাকায় দীর্ঘ দিন যাবৎ আইনানুগ আর্থিক লেনদেনের পেশায় যুক্ত, সারদা গোষ্ঠী তাঁহাদের ব্যবহার করিয়াছিল নিজেদের বিনিয়োগ জোগাড় করিবার কাজে। তাঁহারা বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। মানুষ তাঁহাদের বিশ্বাস করিয়াছিলেন। সেই বিশ্বাস ভাঙিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় নেই-রাজ্যে এই ক্ষতি অপূরণীয়।
সারদা গোষ্ঠীর এজেন্টদের মানুষ বিশ্বাস করিয়াছিলেন কেন? তাহার প্রেক্ষিতে ছিল আর একটি বিশ্বাস সরকারের প্রতি বিশ্বাস। মানুষ জানিতেন, সারদা গোষ্ঠীর পিছনে সরকার আছে। এই ধারণাটি কেন গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহা গত এক সপ্তাহে বহুচর্চিত। কিন্তু সরকারের প্রতি মানুষের এই বিশ্বাস কিঞ্চিৎ মনোযোগ দাবি করে। সরকার, তাহা যে রঙেরই হউক না কেন, মানুষের বিশ্বাসভঙ্গ করিয়াই থাকে। তবুও মানুষ সরকারকে, রাজনীতিকদের বিশ্বাস করে, বিপদে পড়িলে তাঁহাদের নিকট ছুটিয়া যায়। কেন মানুষ ঠেকিয়াও শিখে না? তাহার দুইটি ব্যাখ্যা সম্ভব। এক, বিশ্বাস করিবার ন্যায় আর কোনও প্রতিষ্ঠান মানুষের নাগালে নাই; দুই, এখনও রাষ্ট্রের সহিত নাগরিকের পিতা-সন্তানের সম্পর্কটি সাধারণ মানুষ অস্বীকার করিতে পারে নাই। এখনও সরকারই মানুষের মা-বাপ। সম্ভবত দুইটি ব্যাখ্যাই সত্য। মানুষের নিকট বিশ্বাসযোগ্য থাকিবার দায় সরকারের ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তিনি দাবি করিয়াছেন, পয়লা বৈশাখের পূর্বে তিনি নাকি কিছুই জানিতেন না। এই অজ্ঞানতা আশীর্বাদ নহে, চরম অপরাধ। তিনি যখন নয় কোটি মানুষের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, তখন এই দায়িত্ব এড়াইয়া যাইবার কোনও অধিকার তাঁহার নাই। তাঁহার ব্যর্থতায় পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বাসের মৃত্যু হইল। বেদনাদায়ক মৃত্যু।
এই বিপর্যয়ের দায় কাহার, সেই চাপানউতোর চলিতেছে। চলিবে। বামপন্থীরা, নিশ্চিত ভাবেই নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানটি পোক্ত করিবার জন্য, বিপর্যয়ের আংশিক দায় স্বীকার করিয়াছেন। কেন এই জাতীয় আর্থিক বেনিয়মকে আরও কড়া হাতে সামলাইবার উপযুক্ত আইন নাই, সেই প্রশ্নও উঠিয়াছে। সারদা গোষ্ঠী বেআইনি লেনদেন করিতেছে, সেই কথা জানিবার পর চূড়ান্ত নোটিস পাঠাইতে সেবি-র তিন বৎসর সময় লাগিল কেন, এই প্রশ্নটিও অনিবার্য। দোষ সকলেরই, অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু সকলের দোষ সমান নহে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতই তাঁহার পূর্বসূরিদের এই পাপের সমান ভাগীদার করিতে উদগ্রীব হউন, বাস্তব তাহা মানিবে না। মানুষের বিশ্বাস ভাঙিবার দায়টি মূলত তাঁহার দলের, তাঁহার সরকারের। দলের নেতা-জনপ্রতিনিধি-মন্ত্রীদের সম্পর্কে যে ভাবে এই চূড়ান্ত অসৎ ব্যবসার সহিত জড়িত থাকিবার অভিযোগ উঠিয়াছে, তাহা কিছু ক্ষেত্রে আইনি, এবং সমস্ত ক্ষেত্রে নৈতিক অপরাধ। মানুষ তাঁহাদের কতখানি বিশ্বাস করে, এবং সেই বিশ্বাস পশ্চিমবঙ্গের প্রাণবায়ুর পক্ষে কতটা অপরিহার্য, তাঁহারা নিশ্চয়ই জানিতেন। সেই বিশ্বাসের অপব্যবহার কেবল অন্যায় নহে, অত্যন্ত ক্ষতিকর। কী ভাবে সেই ক্ষতি পূরণ করিবেন, তাহা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবেচ্য। কিন্তু এই বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা না করিতে পারিলে রাজ্যের সর্বোচ্চ অভিভাবক হইবার নৈতিক অধিকার তাঁহার থাকিবে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.