সারদা-কাণ্ডের চাপ পড়ছে অন্য লগ্নি সংস্থার উপরে। কিছু সংস্থা মেয়াদ ফুরনোর আগেই টাকা ফেরত দিচ্ছে, তবে কিছুটা কেটে। কেউ যথাসময়ে টাকা ফেরতের আশ্বাস দিচ্ছে। কেউ আগাম ফেরতের আবেদন গ্রহণ করছে শুধু। নানা জেলায় লগ্নি সংস্থাগুলির দফতরের সামনে মানুষের ভিড় দেখা যাচ্ছে। তবে অনেকেই বাজার আর একটু দেখতে চাইছেন, এখনই সংস্থার সঙ্গে বিরোধে যেতে চাইছেন না।
কাটা গেল ১০-২৫%
মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে রোজভ্যালী। সংস্থার চুঁচুড়া শাখার সিনিয়র অফিসার সমর পাল জানান, সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, ১০-২৫ শতাংশ কেটে মূল টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। সংস্থার দাবি, দুর্গাপুরে আমানতকারী প্রায় ৫০ হাজার, এদের সাড়ে তিন হাজার মেয়াদ ফুরনোর আগেই টাকা তোলার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় চারশো জন চেক নিয়েছেন। যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁদের ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সোমবার নগদে মিটিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। বর্ধমান শহরের নবাবহাটে রোজভ্যালীর অফিসে আমানতকারীদের আবেদন জমা নিয়ে স্ট্যাম্প মেরে ফটোকপি ফেরত দেওয়া হয়। জুনের মাঝামাঝির মধ্যে চেকে টাকা ফেরতের আশ্বাসও দেওয়া হয়। মূলধন থেকে টাকা কাটায় ক্ষুব্ধ হলেও গ্রাহকরা টাকা ফেরত নিচ্ছেন।
এ দিন বর্ধমানের গোলাপবাগে ‘প্রয়াগ’ সংস্থার অফিসে আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেন। শাখা ম্যানেজার অরূপ মাঝি বলেন, “কিছু লোক মারধর, ভাঙচুর করেন। তাই আজ আলোচনা করতে পারিনি। পরে আবেদনের ক্রমিক নম্বর হিসেবে আমানতের টাকা ফেরত দেব।” চুঁচুড়ায় ‘গোল্ডেন লাইফ অ্যাগ্রো ইন্ডিয়া লিমিটেড’ নামে একটি অর্থলগ্নি সংস্থার ডিরেক্টর টিপু সুলতানের দাবি, “আমানতকারীরা টাকা ফেরত চাইলে দিয়ে দেওয়া হবে।” তবে এখনও অবধি কেউ তা চায়নি, জানান তিনি।
অপেক্ষার অনুরোধ
অনেক সংস্থা টাকা আগাম ফেরত দেওয়ার রাস্তায় যাচ্ছে না। বর্ধমান সানমার্গ সংস্থার বাঁকুড়ার এজেন্ট রাজেশ দাস বলেন, “সময়ের আগে অনেকেই টাকা তুলতে চাইছেন। কিন্তু যাঁদের আমানতের মেয়াদ শেষ হয়েছে তাঁরাই টাকা পাচ্ছেন।” দুর্গাপুরে বেনাচিতির ভিড়িঙ্গি মোড়ের অ্যাসপেন গ্রুপের কার্যালয়ের ম্যানেজার সুখদেব দাস, ‘এমপিএস গ্রিনারি’ সংস্থার সহকারী ম্যানেজার সুদীপ বর্ধন, পুরুলিয়া শহরের বিটি সরকার রোডে ‘কেডব্লিউআই’-র এক প্রতিনিধি, সবাই জানান, মেয়াদ শেষের আগে টাকা ফেরতের নিয়ম নেই। ডুয়ার্সের ফালাকাটায় ‘অ্যাঞ্জেল এগ্রিটেক লিমিটেড’-এর ম্যানেজার বিমল বর্মন, দুর্গাপুরে ‘হিমাঙ্গিনি ইনফ্রাকন প্রাইভেট লিমিটেড’ সংস্থার আধিকারিক সুপ্রিয় দে-রা বলেন, আগাম ফেরতের বিষয়ে তাঁদের সংস্থায় কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ‘র্যামেল’-এর বহরমপুর শাখার ম্যানেজার সঙ্গীতা চক্রবর্তীও বলেন, “মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে সংস্থা থেকে টাকা তুলে নিতে আগ্রহীদের চাপ রয়েছে। কিন্তু মেয়াদ পূরণের আগে টাকা ফেরত দেওয়ার নিয়ম নেই। আমাদের হেড অফিস থেকেও এমন নির্দেশ পাইনি। ফলে আমাদের কিছু করার নেই আমানতকারীদের সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি।”
বিক্ষোভ সামাল দিতে
বেশ কিছু সংস্থার দফতরে গিয়ে দেখা গেল, আমানতকারীদের চাপ সামলাতে তারা পূর্ণ নিরাপত্তা নিয়েছে, পুলিশের সাহায্যও নিচ্ছে। গত শনিবার ‘আইকোর’-এর ঝাড়গ্রাম শাখায় টাকা ফেরত না পেয়ে ভাঙচুর চালান কিছু গ্রাহক। ওই শাখার ম্যানেজার সঞ্জয় হালদার জানান, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে আমানত ফেরত না পেয়ে গ্রাহকেরা গোলমাল করছেন, এ কথা তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছেন। বাগনানে ‘টাওয়ার’ গ্রুপের জেলা কার্যালয়ে ভিতর থেকে দরজায় তালা মারা। অচেনা কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এজেন্টরা পরিচয়পত্র দেখালে তালা খুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা। উলুবেড়িয়ায় ‘ক্যালকাটা ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’-এর কার্যালয়েও মেয়াদের আগে যাঁরা টাকা পেতে জেদাজেদি করছেন, সংস্থার কর্মীরা তাঁদের থানায় যাওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন।
উত্তর ২৪ পরগনায় মেয়াদ পেরনোর পরেও একটি সংস্থার গ্রাহকরা টাকা পাচ্ছিলেন না বলে অভিযোগ। আপৎকালীন পরিস্থিতি সামলাতে এজেন্টরাই নিজেরা তহবিল তৈরি করে সংস্থাটির তহবিলের সঙ্গে যৌথ ভাবে টাকা ফেরত দিচ্ছেন।
আশ্বাসে আস্থা
অর্থলগ্নি সংস্থার আশ্বাসে আস্থা রাখছেন, এমন কিছু মানুষও আছেন। রায়গঞ্জের মোহনবাটি এলাকার ব্যবসায়ী নিত্য ঠাকুর শহরের এমজি রোড এলাকার একটি অর্থ লগ্নি সংস্থায় পাঁচ বছরের মেয়াদে ২০ হাজার টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করেছেন। ইতিমধ্যেই তাঁর লগ্নির মেয়াদ ২৮ মাস পেরিয়ে গিয়েছে। নিত্যবাবু বলেন, “সংস্থার কর্তারা জানিয়েছেন, আতঙ্কের কিছু নেই। নির্দিষ্ট সময়ে সুদ সমেত টাকা ফিরিয়ে দেবেন। তবে আমি চাইলে তাঁরা টাকা ফেরত দিয়ে দিতে পারেন। তাঁদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে টাকা ফেরত নিইনি।” আইকোর-এর শিলিগুড়ি শাখায় টাকা রাখা সুজিত দাসের বক্তব্য, “সারদা-কাণ্ডের পরে ভয় পেয়েছি। তবে কোম্পানি ভরসা দিয়েছে। কিছু দিন দেখতে চাই।”
এমনকী, এই বাজারে ঝুঁকি নিতে পিছপা নন, এমন আমানতকারীও আছেন। ‘ভিবজিওর’ সংস্থার সঞ্জয় কুণ্ডু বলেন, “কোনও আমানতকারী যদি অন্য কাউকে ডিবেঞ্চার বিক্রি করতে চান, আমরা ২৫-৩০% অর্থ কেটে নিয়ে সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির নামে ডিবেঞ্চার তৈরি করে দিচ্ছি।”
তবে সারদার সঙ্গে আরও কিছু সংস্থার ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। সোমবার সকালে আরামবাগের বাসুদেবপুরে ‘ইউরো গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ নামে একটি অর্থলগ্নি সংস্থার অফিসে হানা দিয়ে তিনটি কম্পিউটার ও বেশ কিছু নথিপত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এ দিন দুপুরে দেবপ্রকাশ গণ নামে সারদা গোষ্ঠীর এক শাখা ম্যানেজারকে গ্রেফতার করেছে আসানসোল উত্তর থানার পুলিশ।
আগাম সতর্কতা
সোমবার মেদিনীপুর পুরসভার এক জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সারদার মতো যে সব আর্থিক সংস্থা কম সময়ে টাকা দ্বিগুণ-তিন গুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজার থেকে টাকা তোলে, তাদের ট্রেড লাইসেন্স আপাতত পুনর্নবীকরণ করা হবে না। এই ধরনের নতুন সংস্থাকেও ট্রেড লাইসেন্স দেবে না পুরসভা। ভবিষ্যতেও সেবি, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ছাড়পত্র থাকলে তবেই নতুন লাইসেন্স দেওয়া হবে, অথবা পুনর্নবীকরণ করা হবে। |