গল্প আর শোনা হল না মেয়ের
কালে বাড়িতে পুজো দিয়ে তিস্তা ডিঙোতে রওনা হন শৈলেন্দ্রনাথবাবু। তার পর থেকেই ঠাকুর ঘরেই স্বামীর জন্য প্রার্থনা শুরু করেন স্ত্রী। ভেবেছিলেন, ঠাকুর তো প্রত্যেকবারই প্রার্থনায় খুশি হয়ে সফল করেছিলেন স্বামীকে। এ বারেও তার অন্যথা হবে না। কিন্তু, এ বার আর স্বামী ফিরলেন না। রবিবার দুপুরে দড়িতে বেণী বেঁধে শূন্যে ঝুলে সেবকে তিস্তা নদী পার হওয়ার সময় তাঁর কপিকলের চাকা আটকে যায়। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তিনি তারে ঝুলেই ছিলেন। তাঁকে উদ্ধার করে শিলিগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সে সময় তাঁর দেহে আর প্রাণ ছিল না। এই খবর দেশবন্ধুপাড়ার বাড়িতে পৌঁছাতেই মৃতের স্ত্রী সরস্বতী ডুকরে কেঁদে দৌড়ে গিয়েছেন সেই ঠাকুর ঘরেই। কেন এমন হল? প্রশ্ন তুলে আর্তনাদ শুরু করেন তিনি। প্রতিবেশীরা জড়ো হন তাঁর বাড়িতে। গোটা পাড়ায় কান্নার রোল পড়ে যায়।
দেহ আঁকড়ে কান্না মেয়ের। রবিবার শিলিগুড়ি হাসপাতালে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
শৈলেন্দ্রবাবুর দুই ছেলে সুরোজিৎ, বিশ্বজিৎ, মেয়ে মিলি খবর পেয়ে ছুটে যান শিলিগুড়ি হাসপাতালে। তাঁরা বলেন, “এ ভাবে বাবা চলে যাবে ভাবতেই পারছি না। সকালেই বললেন, তোরা সেবকে আয়। ভেবেছিলাম যাব। কাজের চাপে সময় পাইনি। ভেবেছিলাম বাবার কাছে পরে গল্প শুনব। তা কোনও দিন গল্প শোনা হল না।” মিলি হাসপাতালের সামনে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। সকালে শৈলেন্দ্রনাথবাবুর সঙ্গে একই গাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁর দাদা বিনয় রায়। তিনি বলেন ‘‘শৈলেন্দ্র একের পর এক রেকর্ড করছেন। কখনও টিকি দিয়ে টয় ট্রেন টানছে, কখনও পাহাড় ডিঙোচ্ছে। আমাকে বার বার বললেও যেতে পারেনি। এবারেই প্রথম যাই। চোখের সামনে বিপদে পড়তে দেখেও ওঁকে সাহায্য করতে পারলাম না।”
শৈলেন্দ্রর কীর্তি
শিলিগুড়িতে তরাই স্কুলের মাঠে বহুতল থেকে ঝুলে ঝুলে নামছেন শৈলেন্দ্রনাথ।—ফাইল চিত্র।
কেমন মানুষ ছিলেন শৈলেন্দ্রনাথ রায়?
শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটে হোমগার্ডের চাকরি করতেন তিনি। বর্তমানে সহকারি পুলিশ কমিশনার গণেশ বিশ্বাসের গাড়ি চালাতেন। পুলিশ মহলে তো বটেই, সাধারণ মানুষের কাছেও শৈলেন্দ্রবাবুর ‘হিরো’র তকমা পেতেন। এমন এক সহকর্মীরা এ ভাবে মৃত্যুটা কেউই মেনে নিতে পারছেন না পুলিশ মহলের অধিকাংশরাই। তাঁদের একাংশের তরফে অভিযোগ, সঠিক সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকাতেই এদিন মৃত্যু হয়েছে। শরীরে একটি লাইফ জ্যাকেট ছাড়া সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তিস্তা থেকে তিনশো ফুট উপরে যে ব্যক্তি শূন্যে ঝুলে ৪০০ মিটার দূরত্ব পার হবেন, শুধু লাইফ জ্যাকেটে তাঁর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা জানান, স্বাভাবিক ভাবে এ ধরনের অভিযান করতে হলে নিচে একটি জালের ব্যবস্থা করতে হয়। পাশাপাশি, আরেকটি তার এবং প্রশিক্ষিত কর্মীদের রাখতে হয়। সেই সঙ্গে দেহের সঙ্গে একাধিক হুক দিয়ে তার ঝোলানো হয়ে থাকে। যাতে একটি কাজ না করে অন্যটির সাহায্য নেওয়া যায়। দমকল, চিকিৎসক, নিদেনপক্ষে একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকা জরুরি ছিল। কিন্তু তার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। অথচ তিনি যে এ ধরণের একটি অভিযান করতে যাচ্ছেন তা জানিয়ে আবেদন করে ছুটি নিয়েছিলেন শৈলেন্দ্রনাথবাবু।
শৈলেন্দ্রর কীর্তি
শিলিগুড়ি জংশন স্টেশনে টয় ট্রেন টানছেন শৈলেন্দ্রনাথ।—ফাইল চিত্র।
বিষয়টি পুলিশের একটি অংশের তরফেই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শৈলেন্দ্রবাবুর পরিবারের একজনের চাকরির দাবি, এ ছাড়া যাদের গাফিলতিতে ওই ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাবেন তারা। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার কারলিয়াপ্পন জয়রামন বলেন, “শৈলেন্দ্রনাথবাবু এ ধরণের অভিযান মাঝে মধ্যেই করতেন। তিনি নিজের উদ্যোগেই সব করতেন। আমাদের কাছে ছুটি চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তা করা হয়েছে। কিন্তু, এ ধরণের দুঃখজনক ঘটনা ঘটবে তা ভাবতে পারিনি। এ ছাড়া সেখানে নিরাপত্তার কি ব্যবস্থা ছিল, অ্যাম্বুল্যান্স ছিল কি না তা বলতে পারব না। তাঁর পরিবারকে সবরকম সহযোগিতা করা হবে।”
সহকারি পুলিশ কমিশনার গণেশ বিশ্বাস বলেন, “আমি এ নিয়ে কিছু বলব না।” সেবকের ওই এলাকা দার্জিলিং জেলা পুলিশের অধীন। দার্জিলিং জেলা পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল জানান, শৈলেন্দ্রনাথবাবু ওই অভিযান নিয়ে আগাম কোনও খবর পুলিশকে দেয়নি। তিনি বলেন, “নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য পুলিশ সেখানে যায়। শৈলেন্দ্রনাথবাবুর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সব ব্যবস্থা রয়েছে বলে দাবি করেন। একটি লিখিতিও দেন। তার পরে এই ঘটনা শুনে খুব খারাপ লেগেছে। তাঁর পরিবারের পাশে আমরা রয়েছি।”
খবর পেয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব হাসপাতালে যান। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেন, “শীঘ্রই শৈলেনবাবুর বাড়িতে যাব। ওঁর পরিবারকে সাহায্য করতে সব রকম ভাবে চেষ্টা করব।” হাসপাতালে যান প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, রাজ্যের স্বাস্থ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য-সহ অনেকেই। যে দেশবন্ধু পাড়ায় শৈলেনবাবু থাকেন সেখানকার কাউন্সিলর স্বপন দাস আমন্ত্রণ পেয়ে এ দিন শৈলেনবাবুর অনুষ্ঠান দেখতেও গিয়েছিলেন। দুর্ঘটনা পর হতবাক তিনিও।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.