আর এক চুলও এগোনো যাচ্ছে না। তিনশো ফুট নীচে খরস্রোতা তিস্তা। মাথায় বেণীর সঙ্গে বাঁধা কপিকল জড়িয়ে রয়েছে তারে। কিন্তু পাড় তখনও আরও একশো মিটার। সেই অবস্থাতেই ছটফট করতে করতে রবিবার দুপুরে সেবকের করোনেশন সেতুর কাছে মারা গেলেন শৈলেন্দ্রনাথ রায় (৫০)।
বছর সাতেক আগে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে সমুদ্রের তলায় গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ-এ স্টিং রে মাছের করাতের মতো হুলের আঘাতে মারা গিয়েছিলেন ‘ক্রোকোডাইল হান্টার’ নামে বিখ্যাত অভিযাত্রী স্টিভ আরউইন। একের পর এক দুঃসাহসী কাণ্ড করার পরে স্টিভ ভাবতেও পারেননি, স্টিং রে আচমকা তাঁকে এ ভাবে আক্রমণ করতে পারে। স্টিভের মতোই শৈলেন্দ্রও গিনেস বুকে নিজের নাম তুলিয়েছেন। তিনিও ভেবেছিলেন, অনায়াসে ওই দূরত্ব বেণীতে ঝুলে পার হয়ে যাবেন। বেণীতে বেঁধে ট্রাক থেকে টয়ট্রেন পর্যন্ত এর আগে টেনেছেন তিনি। বেণীতে ঝুলে সব থেকে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করার গিনেস রেকর্ড রয়েছে তাঁর নামে। ২০১১ সালের ১ মার্চ রাজস্থানে করা সেই রেকর্ড নিজেই ভাঙতে এ বার কার্শিয়াং থানার সেবকের কাছে ৪০০ মিটার দূরত্বের তিস্তা ওই একই ভাবে পার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন শৈলেন্দ্র। |
এ ভাবেই ঝুলন্ত অবস্থায় মৃত্যু হয় শৈলেন্দ্রনাথ রায়ের। সেবকে রবিবার। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক। |
দু’পাশে তখন প্রায় হাজার দশেক লোক। শুরু হয় তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা। প্রায় ৪০ মিনিট তিনি ঝুলে ছিলেন তিস্তার উপরে। করোনেশন সেতু থেকে দড়ি ছুড়ে কপিকলটিকে টেনে আনার চেষ্টা করতে থাকেন দর্শকরা। সেই ভাবেই তাঁকে টেনে এক পাড়ে এনে অ্যাম্বুল্যান্সে করে শৈলেন্দ্রকে শিলিগুড়ির হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে তাতে শেষরক্ষা হয়নি।
দর্শকদের অনেকেরই বক্তব্য, শৈলেন্দ্রের মৃত্যুর জন্য দায়ী পুলিশ-প্রশাসনের উদাসীনতা। পেশায় হোমগার্ড শৈলেন্দ্র শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের গাড়ি চালক। কিন্তু এই দুঃসাহসী কাজ করার জন্য যা যা সুরক্ষা ব্যবস্থা দরকার ছিল, তার কিছুই ছিল না। তিস্তার উপরে জাল ছিল না। শৈলেন্দ্রের দেহ যে ভাবে অন্য একটি তারে ঠিক মতো বেঁধে রাখা দরকার ছিল, তা-ও ছিল না। শৈলেন্দ্র সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগেই পুরো আয়োজন করেছিলেন। করোনেশন সেতুর সেবক কালীবাড়ির দিকে নামছিলেন তিনি। উল্টো পাড়ে মংপং থানা এলাকায় পাহাড়ের গায়ে প্রায় দেড়শো ফুট উপরে লোহার বিমের সঙ্গে ৬ মিলিমিটার চওড়া লোহার তারটি বেঁধেছিলেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা। নদীর উপরে আড়াআড়ি ভাবে উপর-নীচ কোণাকুণি করে কালীবাড়ির দিকেও একটি লোহার বিমের সঙ্গে বাঁধা ছিল তারটি। মংপঙের দিকটি বাঁধা ছিল কালীবাড়ির দিক থেকে প্রায় দেড়শো ফুট উঁচুতে। শৈলেন্দ্র ভেবেছিলেন উপর থেকে ওই কপিকল তারের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নীচে নেমে আসবে। সেই মতো কপিকলের সঙ্গে বেণী বাঁধা অবস্থায় তিনিও নেমে আসতে পারবেন। সেই মতো বেলা ১টা ৩৫ মিনিট নাগাদ কপিকলে বেণী বেঁধে তার বেয়ে যাত্রা শুরু করেন তিনি। |
দড়ি থেকে নামিয়ে আনার পরে। —নিজস্ব চিত্র। |
কিন্তু মাঝখানে আটকে গেলেন কেন? উপস্থিত দর্শকদের বক্তব্য, কপিকলের সঙ্গে তাঁর বেণীর চুল জড়িয়ে গিয়েছিল। তাই কপিকলটি আর নড়ছিল না। সে সময়েই তিনি প্রাণপণে কপিকলটি খোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু অত নীচে খরস্রোতা তিস্তা বা পাথর দেখে সম্ভবত ভয়েই মারা গিয়েছেন তিনি। তবে অনেক
দর্শকের মত, তারের ঢাল ঠিক ছিল না। তাঁর যা ওজন এবং যে দূরত্ব তিনি পার হতে চেয়েছিলেন, তাতে দুই প্রান্তের মধ্যে মাত্র দেড়শো ফুটের ঢাল তৈরি করা ঠিক হয়নি। তিনশো মিটার পর্যন্ত তিনি চলে এসেছিলেন, তারপরে তাঁর দেহের ওজনের ভারে তার ঢিলে হয়ে গিয়ে ঢাল কমে যায়। তাই কপিকল আর নড়তে চায়নি।
সেই সময়ে প্রশাসনের কাউকে ধারে কাছেও দেখা যায়নি। কেউ যে জানতেন না তা নয়। শনিবারই গিয়ে করোনেশন ব্রিজের কাছে তারটি বেঁধেছিলেন শৈলেন্দ্র। অভিযান শুরুর মাত্র ৩০ মিনিট আগে সেবক ফাঁড়িতে তিনি একটি লিখিত চিঠিও জমা দেন। তাতে অবশ্য তিনি জানিয়েছিলেন, নিজের উদ্যোগেই অভিযানে নামছেন। তবে মাস খানেক আগেই প্রশাসন এবং পুলিশের বিভিন্ন মহলে তিনি কী করতে চলেছেন তা চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। এমনকী সাংবাদিক সম্মেলন ছাড়াও হোর্ডিং, বিজ্ঞাপন দিয়ে অনুষ্ঠানের কথা প্রচার করেছিলেন। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “এই ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া দরকার। আগে থেকেই ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনা ঘটত না। কেউ কিছু করেননি।” হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অনিমেষ বসু জানান, শৈলেন্দ্র কয়েকদিন আগে তাঁদের কাছ থেকে লাইফ জ্যাকেট-সহ কিছু জিনিস নিয়ে যান। অনিমেষবাবু বলেন, “তখন কিছু সতর্কতার কথা বলি। আমাদের প্রশিক্ষিত লোক পাঠানোর কথাও বলি। তিনি কিন্তু কোনও সাহায্যই নিতে চাননি। যা হল তাতে মনে হচ্ছে, সেই সতর্কতায় খামতি থেকে গিয়েছিল।” |
তিস্তা পেরোনোর আগে শৈলেন্দ্রনাথের বেণী জোড়া হচ্ছে কপিকলে।— নিজস্ব চিত্র। |
শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার কে জয়রামনের বক্তব্য, “শৈলেন্দ্র সাত দিনের ছুটিতে ছিলেন। এটা পুলিশের কোনও অনুষ্ঠানও ছিল না। তবে অনুষ্ঠানটি নজরে ছিল ঠিকই। তবে এটা একদম ওঁর ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান ছিল। তবে পুলিশ কেন আগাম ব্যবস্থা নিল না, তা নিয়ে এখনই কিছু
বলছি না। আপাতত ওঁর পরিবারকে কীভাবে সাহায্য করা যায় তা দেখছি।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও জানান, শৈলেন্দ্রের পরিবারকে কী ভাবে সাহায্য করা যায় তার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, “আগাম অনুমতির বিষয়টি কী ছিল তা খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
এই ঘটনার পরে পরিবারের লোকজনদের কেউই ভাল করে কথা বলতে পারছেন না। ঘনঘন মূর্চ্ছা যাচ্ছেন শৈলেনবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবী। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। বড় ছেলে বিশ্বজিৎ গাড়ি চালান। তিনি কোনও মতে জানালেন, “বাবা অসম্ভব জেদি ও দুঃসাহসী ছিলেন। আমাদের বলেছিলেন, সেনাবাহিনীতে সাহসিকতার কাজ করলে পদোন্নতি হয়, অথচ পুলিশে আমার কিছু হচ্ছে না। সেবকে তিস্তা পেরিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিতে এলাকায় দু’টি নারকেল গাছের মধ্যে দড়ি বেঁধে অনেক প্র্যাকটিস করেছিলেন। আমরাও অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু কার দোষে সব কিছু দুঃস্বপ্নে বদলে গেল তা বুঝতে পারছি না!” |