অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা তুলিয়া দিবার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব দিয়াছে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এই সিদ্ধান্ত তিন বৎসর আগে প্রণীত শিক্ষার অধিকার আইনের অভিযোগ, পাশ-ফেল উঠিয়া যাওয়ায় পড়ুয়াদের লেখাপড়া শেখার তাগিদ কমিয়াছে। ফলে বিদ্যাশিক্ষার মানের অবনতি হইয়াছে। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অনেকেরই দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির বিদ্যাও অধীত নয়! এমনটাই যে ঘটিবে, তাহার সতর্কবাণী কিন্তু সমাজে অনুপস্থিত ছিল না। শিক্ষাবিদরা তো বটেই, সমাজ লইয়া চিন্তাভাবনা করেন, এমন অনেকেই পাশ-ফেল প্রথা রদ করার বিরুদ্ধে সরকারকে হুঁশিয়ার করিয়াছিলেন। অতিরিক্ত চাপের মুখে শিশু পড়ুয়ারা মাঝপথে পড়া ছাড়িয়া দিতেছে কিংবা অমনোযোগী হইয়া পড়িতেছে, এই যুক্তিতে এককালীন বাৎসরিক মূল্যায়নের যুগ-পরীক্ষিত বন্দোবস্তটি তুলিয়া দেওয়া হয়। সেই সময়েই বলা হইয়াছিল, উচ্চতর শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ পাইতে পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার দরকার নাই, এই নির্ভয়তাই বরং পড়ুয়াদের লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও উদাসীন করিয়া তুলিতে পারে। ক্লাসে উঠিবার জন্য লেখাপড়া করার প্রয়োজন নাই, আপনিই উঠিয়া যাওয়া যাইবে, এই নিশ্চয়তা পড়ুয়াদের অধ্যয়নের প্রতি আসক্তি বাড়াইবে না, হ্রাস করিবে। ইহা বুঝিবার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার হয় না, শিক্ষা মন্ত্রকের আমলা হওয়ারও দরকার পড়ে না। বরং ইহা ভাবিয়াই আশ্চর্য লাগে যে, এই সহজ সত্য উপলব্ধি করিতে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক নিযুক্ত বিশেষজ্ঞদের এত দিন লাগিয়া গেল।
লেখাপড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের উপর যে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া অনুচিত, চাপ বেশি হইয়া গেলে লেখাপড়ার আগ্রহই হারাইয়া ফেলার সম্ভাবনা, এ কথা শিশু মনস্তাত্ত্বিকরা বারংবার বলিয়াছেন। পরীক্ষা-ভিতি নামক বস্তুটিও সুপরিচিত। কিন্তু পরীক্ষা তুলিয়া না দিয়াও সেই ভীতি কী ভাবে কমানো যায়, তাহার চেষ্টা হইয়াছে কি? যদি কোনও ধরনের মূল্যায়ন-বন্দোবস্তই না থাকে, পরীক্ষা জিনিসটাই তুলিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলেই কি পড়াশুনার প্রতি শিশুদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়? পায় না। একটি পরীক্ষায় পাশ-ফেল-এর পরিবর্তে বছরভর মূল্যায়নের বিকল্প পদ্ধতিটাও সে ভাবে কার্যকর হয় নাই। ফলে শিশুরা কতটা কী শিখিতেছে, আদৌ কিছু শিখিতেছে কি না, তাহার হদিশও লওয়া হয় না।
অনেক দেশে, এমনকী এ দেশেরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটি অংশে এই ধরনের বিকল্প মূল্যায়নের পদ্ধতি সুফল দিয়াছে, সত্য। কিন্তু যে পরিবেশে যে সব শর্ত পূরণের ফলে তাহা সম্ভবপর হইয়াছে, অধিকাংশ স্কুলে তাহার স্বপ্নও অলীক। অনেক ভাবনা বা আদর্শ কোনও বিশেষ সমাজে মঙ্গল আনিলেও অন্য সমাজে সেই ধারণা বা আদর্শের যান্ত্রিক প্রতিস্থাপন অমঙ্গলের আহ্বায়ক হইতে পারে। নূতন কিছু করার তাড়না ভাল। কিন্তু নূতন হইলেই তাহা কল্যাণকর হয় না। শিক্ষার মৌলিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটাইবার আগে পরিণাম বিশদ বিবেচনা করা অবশ্যকর্তব্য। |