সুদীপ্তদের পর কে হবে পুজোর গৌরী সেন
ঢাকে কাঠি পড়তে ঢের বাকি। এখনই বিসর্জনের বাদ্যি অনেকের মনে! সারদা গোষ্ঠীর প্রতারণার পর্দায় টান পড়তেই বাঙালির পুজোর আকাশে বিপর্যয়ের ছায়া।
পুজোর উদ্যমী সংগঠক এক ডাকাবুকো মন্ত্রী। এতটাই মন খারাপ যে এ বার নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসতেই কোলাহল থেকে সন্ন্যাস নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তবে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার অবস্থা আর এক নেতার, “ওরা আমাকেও ধরেছিল। জোর বেঁচেছি, ভাগ্যিস ভুঁইফোঁড় সংস্থার টাকা ছাড়াই পুজো করেছিলাম!”
শারদোৎসবের জাঁকজমকের নেপথ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা। সারদা, রোজ ভ্যালী, আইকোর-এর মতো চেনা-অচেনা বহু সংস্থা রয়েছে এই তালিকায়। হেভিওয়েট পুজোর গেট, হোর্ডিং, পুজো উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে হরেক কিসিমের পুরস্কারে ভুঁইফোঁড়দের বিশেষ অবদান। পোড়খাওয়া পুজো-কর্তাদের হিসেবে, পুজোর প্রসার-পৃষ্ঠপোষকতায় এই অঙ্কটা কম করেও ৬-৭ কোটি টাকা। আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে এই সব সংস্থাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে পুজোর আয়োজন থেকে বিপুল অর্থ ছেঁটে ফেলতে হবে। ফলে স্পনসরশিপে বড়সড় চোট লাগার আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
দুশ্চিন্তা সব থেকে বেশি নেতা-মন্ত্রীদের পুজোর কর্মকর্তাদের। দক্ষিণ কলকাতার উপকণ্ঠের একটি পুজো নামী শিল্পীকে দিয়ে আগাগোড়া রুপোর কাজ করানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্পে হাত দেওয়ার কথা ভাবছিল।
স্পনসররা মুখ ফিরিয়ে নিলে সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে। উত্তরের একটি পুজোও ঘনিষ্ঠ স্পনসর-গোষ্ঠীর সহৃদয়তার ভরসায় দামি থিম-শিল্পীর সঙ্গে কথা পাকা করে ফেলেছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে তারাও উৎকণ্ঠায়। অজস্র প্রশ্ন ভাসছে! পূর্ব কলকাতার অমুক পুজোর বচ্ছরকার সাড়ম্বর জলসা এ বার দেখা যাবে তো? কিংবা তমুক সাবেক পুজোর সিঁদুরখেলায় টলিউডের নায়িকাদের ‘ফটো-সেশন’ দেখা যাবে কি না? পুজো বা পুজো-কর্তাদের মেলে ধরার এমন বহু অনুষ্ঠানই উটকো আর্থিক সংস্থার দাক্ষিণ্যের দিকেই তাকিয়ে থাকে।
কেউ কেউ অবশ্য এখনও বুক বাজিয়ে অভয় দিচ্ছেন। রোজ ভ্যালী-র কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুর কথায়, “পুজোয় আমরা ছিলাম, আছি ও থাকব! ১০০ ভাগ নিশ্চিত, আমাদের কিচ্ছু ক্ষতি হবে না!” আইকোর-এর এমডি অনুকূল মাইতিরও আশ্বাস, “এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, বারোয়ারি পুজোর সঙ্গে আমাদের না-থাকার কোনও কারণ ঘটেনি।”
কিন্তু সারদার কেলেঙ্কারির পরে ওই ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থার টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে ভাবমূর্তির প্রশ্নটাও নেতা-মন্ত্রীদের কুরে কুরে খাচ্ছে। পরিবর্তনের পরে মন্ত্রী মদন মিত্র যাদের সঙ্গে জড়িত, তেমন বেশ কয়েকটি পুজোর আমূল ভোল বদল দেখা গিয়েছিল। গত বছরও তাঁর ‘কাছে’-র তিনটি পুজোয় অর্থলগ্নি সংস্থার সৌজন্যে বেশ কয়েক লক্ষ টাকার দাক্ষিণ্য জুটেছিল বলে পুজো-আয়োজকদের সূত্রে খবর।

ভুঁইফোঁড় মেঘ
আমরা মা-মাটি-মানুষের পুজো করি! নিজের অফিসে বড়জোর ছোট্ট পুজো করব। আর কিচ্ছু না!
মদন মিত্র
পাশের লোকটা ভাল না খারাপ, মুখ দেখে বোঝা যায় না! বুঝতে পারলাম, সরিয়ে দিলাম, মিটে গেল!
পার্থ চট্টোপাধ্যায়

ভাগ্যিস সুদীপ্ত সেনকে চিনতাম না। ওঁরা তো নেতাদের পুজোয় টাকা ঢালতে মুখিয়ে থাকতেন।
ফিরহাদ হাকিম
ভুঁইফোঁড়দের সাহায্য ছাড়াই পুজো করে আসছি!
অরূপ বিশ্বাস
মদন আর অহেতুক বদনাম গায়ে মাখতে চান না। তাঁর কথায়, “গত বছরের কথা বাদ দিন। তখনও ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার স্বরূপ বোঝা যায়নি।” শতকরা ৬০ ভাগ পুজোই তথাকথিত চিটফান্ডের টাকা নিয়ে থাকে বলে মানলেও বিতর্কের জেরে আর এ সবের মধ্যে না-থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন তিনি। ঠিক যে ভঙ্গিতে এর-ওর সঙ্গে মেলামেশা, ছবি তোলার বিষয়ে সাবধান হওয়ার কথা বলেছেন, অবিকল সেই ভঙ্গিতেই এ বার বারোয়ারি পুজোর থেকে দূরে থাকার কথা ঘোষণা করছেন মদন। “আমরা মা-মাটি-মানুষের পুজো করি! চৌরঙ্গিতে আমার নিজের অফিসে বড়জোর ছোট্ট পুজো করব। আর কিচ্ছু না!” অভিমান ঝরছে মন্ত্রীর কথায়।
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পুজোয় ‘চিট ফান্ড সংস্রব’ মাত্রেই ছিছিক্কারের কিছু আছে বলে মনে করেন না। ‘পার্থদার পুজো’ নামে পরিচিত নাকতলার এক বারোয়ারিতে এক সময় একটি অর্থলগ্নি সংস্থার কর্তা জড়িত ছিলেন। বাম আমলের এক মন্ত্রী তখন সেই পুজোর উপদেষ্টা। পার্থের কথায়, “তোমার পাশের লোকটা ভাল না খারাপ তা তো মুখ দেখে বোঝা যায় না! বুঝতে পারলাম, সরিয়ে দিলাম, মিটে গেল!” তাঁর মতে, কোন আর্থিক সংস্থা মানুষকে ঠকাচ্ছে সেটা বুঝতে হবে। পোড়খাওয়া পুজো-কর্তা যুবকল্যাণমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসেরও দাবি, “ভুঁইফোঁড়দের সাহায্য ছাড়াই পুজো করে আসছি!” এক পুজো-কর্তার ব্যাখ্যা, অনেক সময়ে পুজো কর্তাদের সঙ্গে এজেন্সি মারফত বিভিন্ন স্পনসরের যোগাযোগ হয়। সব ক্ষেত্রে পুজো-কর্তারা বুঝতে পারেন না, টাকাটা কারা ঢালছে।
কোনও কোনও পুজো আয়োজকের কিন্তু আশঙ্কা, অর্থলগ্নি সংস্থার মতো বাঁধা স্পনসর সরে গেলে, মানুষের উপরে চাঁদার জুলুম ফিরে আসবে। অল্প-স্বল্প টাকার জন্যও ব্যক্তিগত অনুদান জোগাড়ের প্রবণতা দেখা যাবে। অর্থলগ্নি সংস্থা পুজোর গেট বা হোর্ডিং দেওয়ার আশ্বাস দিয়েও কথার খেলাপ করেছে, এমন নজির কিছু-কিছু মিলবে। কিন্তু অনেকেরই মত, রাজ্যে পুজোর এত জৌলসের পিছনে ভুঁইফোঁড়দের বরাভয় জরুরি।
আর এক সফল পুজো-কর্তা ফিরহাদ হাকিম (ববি) অবশ্য কিছুটা ফুরফুরে মেজাজে। তাঁর কথায়, “ভাগ্যিস সুদীপ্ত সেনকে চিনতাম না। যা শুনেছি, ওঁরা তো নেতাদের পুজোয় টাকা ঢালতে মুখিয়ে থাকতেন।” তাঁর পুজোয় ভুঁইফোঁড় সংস্থার সংস্রব ছিল না বলে দাবি করেও ববির অভিমত, জমিয়ে পুজো করতে হলে অনেককেই এ বার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে!
তবে এর মধ্যেও কোনও কোনও কর্মকর্তার মুখে চওড়া হাসি। রাজনৈতিক কোনও ‘দাদার পুজো’-র তকমাহীন উত্তর কলকাতার এক সাবেক পুজো-কর্তা বলছিলেন, “গত বার সারদার মতো কত সংস্থার অফিসে ঘুরেও কানাকড়ি মেলেনি। দাদাদের পুজোই সব নিয়ে গেল! এ বার ঠিক লড়ে যাব!”
সুদীপ্ত সেনরা না থাকলে দাদাদের পুজোয় গৌরী সেন কে হবে? দেখে নেবো গোছের উত্তেজনায় ফুটছেন ওই সাবেক পুজো-কর্তা। প্রশ্নটা দাদাদেরও কম ভাবাচ্ছে না।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.