টালি আতঙ্ক

ভূতেদের ভবিষ্যৎ কী? ভূতেরাও জানে না। কেন?
গত বছরের সব চেয়ে বড় হিট ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর পর অনীক দত্তর পরের ছবি ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ যে এখন রোজ ভ্যালি কোম্পানির জিম্মায়। কেউ কেউ বলছেন ছবি মুক্তি পাবে না। প্রযোজক অবশ্য বলছেন ছবি মুক্তি পাবেই। অনীক দত্ত কিছুই বলছেন না।

২০০৭-এ যে টলিউডে চিটফান্ড লগ্নির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৪০ কোটি টাকা। ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী ২০১৩-তে সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটি টাকায়।
সব চেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য, আজকের টলিউডের প্রায় ৫০ শতাংশ ছবির প্রযোজক এই কোম্পানিগুলি। যদি টাকার স্রোত বন্ধ হয়, মুখ থুবড়ে পড়বে ইন্ডাস্ট্রি।


ওয়েলকাম টু দ্য ওয়ার্ল্ড অব চিটফান্ড ইন টলিউড।
টলিউডের চিটফান্ডের জগতে আপনাকে স্বাগত।

পরের বছর ন’টা ছবি করব
গত বছর জুলাই মাসের ঘটনা।
বাইরে অসম্ভব বৃষ্টির মধ্যেই মিটিং হচ্ছিল এক অভিজাত ক্লাবে।
এমন সময়ে হাজির মধ্য চল্লিশের এক প্রোডিউসর। ডান হাতে চারটে আংটি। তিনটে মোবাইল। দু’টো ব্ল্যাকবেরি। একটা আই ফোন।
এসে পাজেরো গাড়ির চাবিটা ছুড়েই রাখলেন টেবিলে। “সরি দেরি হয়ে গেল। আপনাদের মিটিং কি শেষের মুখে? আসলে পরের বছরের ছবির প্ল্যানিং করছিলাম। পরের বছর এক সঙ্গে ন’টা ছবি শুরু করছি,” প্রায় হুঙ্কারের ঢঙে বলেন তিনি।
আজকে ২৯.০৪.২০১৩।
সেই প্রোডিউসরের ফোন নম্বর শত খুঁজেও পাওয়া গেল না। এবং বলাই বাহুল্য, একটি ছবিও শুরু হয়নি।
ওটা যদি হয় জুলাই মাসের ঘটনা, তা হলে গত বছর এপ্রিলের একটি ঘটনা আরও চমকপ্রদ।
রবিবারের এক সকালে কলকাতার প্রেস ক্লাব থেকে বাসে করে মিডিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় চন্দ্রকোনায়, প্রয়াগ ফিল্ম সিটিতে। সে দিন সেখানে শাহরুখ খান আসবেন।
শাহরুখ এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই ফিল্ম সিটিতে আজও দু’একটি ছাড়া কোনও ছবিরই শ্যুটিং হয়নি।
হাজার হাজার একর জমিতে বিরাট কয়েকটা সেট। কিন্তু বাকি ইনফ্রাস্ট্রাকচার শূন্য। চারিদিকে শুধু বালির মাঠ। শোনা যায় প্রয়াগও চিট ফান্ড ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বহু চেষ্টা করেও প্রয়াগ গ্রুপের কাউকে ফোনে ধরা যায়নি।

অনীক দত্ত পরিচালিত ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ ছবির দৃশ্য

স্টারের সঙ্গে ছবি তুললে টাকা তুলতে সুবিধে হয়
‘মাচো মাস্তানা’ ছবির মিউজিক লঞ্চ। প্রোডিউসর রিম্যাক গ্রুপ। বাজেট ৭ কোটি টাকা। কলকাতার এক বিখ্যাত পাঁচতারা হোটেলে মিউজিক লঞ্চের পরে সব গেস্টকেই দেওয়া হয় ইমপোর্টেড ওয়াইনের বোতল। আর দামি উপহার। ছবি প্রথম সপ্তাহেই ধরাশায়ী। গত সপ্তাহে তাঁরা অফিস বন্ধ করে দিয়েছেন অনির্দিষ্ট কালের জন্য।
এমনকী গত বছর ‘বালুকাবেলা ডট কম’ ছবির প্রযোজনা করেন তৃণমূল সাংসদ এবং সারদা গ্রুপ মিডিয়ার সিইও কুনাল ঘোষ।
এ রকম হাজার হাজার ঘটনা গত চার বছর ধরে ঘটেছে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। প্রায় প্রত্যেক দিন নতুন প্রোডিউসর আসছিলেন ছবি বানাবেন বলে। প্রথম মিটিংয়ে নামীদামি অভিনেতাকে অ্যাডভান্সে ক্যাশ টাকাও তুলে দিচ্ছিলেন।
“এদের অধিকাংশই ছবি চালানোর জন্য টলিউডে আসেনি। এরা এসেছিল ছবির জগতে নিজের পরিচিতি বাড়াতে। খবরের কাগজে বড় বড় স্টারদের
সঙ্গে ছবি ছাপলে অধিকাংশেরই টাকা তুলতে সুবিধে হয়,” বলছিলেন প্রযোজক পীযূষ সাহা।

৫০ শতাংশ ছবিতেই রয়েছে চিটফান্ডের টাকা
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যদিও বা একটা-দু’টো সংস্থা থেকে থাকে, তা হলে গত তিন চার বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ ছবিতেই ইনভেস্ট করেছে এই কোম্পানিগুলো।
“এরা এসে মার্কেটের ব্যালেন্সটা নষ্ট করে দিচ্ছে। যদি এ বার তারা ছবি করা বন্ধ করে, তা হলে একটা ব্যালেন্স ফিরবে টলিউডে। যার যেটা প্রাপ্য নয় সেই রকম পারিশ্রমিক দিয়ে এরা আর্টিস্টদের অভ্যেসও খারাপ করে দিয়েছে। লং টার্ম ক্ষতি হবে ইন্ডাস্ট্রির ওরা থাকলে,” সরাসরি বলছেন ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের শ্রীকান্ত মোহতা।
পারিশ্রমিক নিয়েও চিট ফান্ড কোম্পানিরা কোনও কার্পণ্য সাধারণত করত না।
“ওদের পাবলিকের টাকা। ওরা এসে আমাদের মতো ইনডিভিজুয়াল প্রোডিউসরদের শেষ করে দিয়েছে। যে আর্টিস্ট দু’হাজার টাকা পায়, তাকে দিচ্ছে কুড়ি হাজার টাকা। আজকে যে টালিগঞ্জে তিনটে ছবি করছে সেও বড় গাড়ি নিয়ে ঘোরে। কোথা থেকে এসেছে এই টাকাটা? এগুলো সব চিটফান্ড কোম্পানির দৌলতে হয়েছে,” বলছেন পীযূষ।

বাংলা সিনেমা কি আগে সন্ন্যাসীদের টাকায় হত?
অভিনেতা, পরিচালকেরা অবশ্য কার টাকায় ছবি করছেন সেটা নিয়ে অত ভাবতে চান না। এ বছর যে ছবিটা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে সেই ‘শব্দ’র প্রযোজক রোজ ভ্যালি ফিল্মস। কী বলছেন ‘শব্দ’-র পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়?
“আমরা ফান্ড নিয়ে ছবি করি, চিট কি না আমাদের জানার দরকার নেই তো। ঈশ্বর থেকে ডাকাত সংস্কৃতি চর্চার অধিকার সবার আছে। আমরা সিনেমাটা মন দিয়ে বানাই, চিট ফান্ডের টাকাতে ছবি বলে ফাঁকি দিই না তো। তা হলে আর্টিস্টদের দিকে আঙুল উঠবে কেন? আর এমন ভাব করছেন যেন বাংলা ছবি আগে সন্ন্যাসীদের টাকায় হত? যাঁরা টাকা খুইয়েছেন, তাঁদের পাশে আমরা সব সময় আছি। আর আমার যে প্রোডিউসর, রোজ ভ্যালি ফিল্মস, তাদের বিরুদ্ধে এখনও তো কোনও আইনি অভিযোগ নেই। শুধু শুধু আমরা তাকে টার্গেট করছি বা কেন?” প্রশ্ন কৌশিকের।
একই বক্তব্য আবির চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর ছবি ‘আষাঢ়ে গপ্পো’ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল পরের মাসে। কিন্তু সারদা কাণ্ডের পরে তা এখন পিছিয়ে গিয়েছে। “দেখুন ছবি পিছিয়ে যাওয়াটা তো প্রোডিউসরের উপর। আমরা আর্টিস্টরা তো চিটফান্ডের ছবি বলে দায়সারা কাজ করি না। আমাদের পরিশ্রমটা একই থাকে। আর আমরা আমাদের পরিশ্রমের পারিশ্রমিকটা নিই। কে কী ভাবে টাকা রোজগার করছে সেটা আমাদের জানা সম্ভবই নয়,” বলেন আবির।
সম্প্রতি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বানিয়েছেন ‘হাওয়া বদল’।
সেই ছবির প্রযোজকেরও নানা ব্যবসার মধ্যে ‘মানি মার্কেট’-এ ইনভেস্টমেন্ট ছিল। কী বলছেন পরমব্রত? “আমার মনে হয়, মানি মার্কেট-এর ব্যবসাটা এমনই যে তাতে হাই রিস্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব চিট ফান্ড কোম্পানি ‘সারদা’র মতো। অনেক কোম্পানি আছে, যারা নানা ব্যবসায় নিজেদের ডাইভারসিফাই করেছে, যেমন করেছেন আমার ‘হাওয়া বদল’-এর প্রযোজকেরা। দে আর গুড পিপল,” বলছেন পরমব্রত।
রোজ ভ্যালি ফিল্মস প্রযোজিত ‘মনের মানুষ’ ছবির একটি দৃশ্য

তিরিশ বছর আগে সঞ্চয়িতাও সিনেমায় লগ্নি করেছিল
ইতিহাস কিন্তু ফিরে ফিরে আসে। ইআইএমপিএ বা ইমপা-র সিনিয়র কিছু প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আজকের মতো সেই সময়ও সঞ্চয়িতা একই ভাবে সিনেমায় লগ্নি করত। সঞ্চয়িতার অন্যতম কর্ণধার তপন গুহর মেয়ে লালির নামে শুরু হয়েছিল এই কোম্পানি লালি পিকচার্স। “তাঁরা শুরু করেছিলেন হিন্দি ছবির ডিস্ট্রিবিউশন দিয়ে। মনে আছে সেই সময় ‘লাওয়ারিস’ ছবির দাম যখন ছিল ৩৮ লাখ টাকা সেই সময় ‘শান’ ছবি তাঁরা কিনেছিলেন এক কোটি এক লাখ টাকায়। ওই সময় কারও কাছে অত টাকা ছিল না। এবং তার থেকেও বড় কথা ‘শান’ ছবি বিক্রিও হচ্ছিল না। শুধু ‘শান’ কেন? ওঁরা ‘নসিব’ ছবিও ৭৫ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। ‘খুদ্দার’ও তাঁরাই ডিস্ট্রিবিউট করেছিলেন। মানে অমিতাভ বচ্চন হলেই তাঁরা ছবি কিনতেন,” বলছিলেন সেই সময়ের কলকাতার অন্যতম বড় ডিস্ট্রিবিউটর কৃষ্ণ দাগা।
বাকি খবর নিয়ে জানা গেল, ডিস্ট্রিবিউশন ছাড়া সঞ্চয়িতা দুটি সিনেমাহলও কিনেছিল। বারাসাতের লালি সিনেমা ও দমদমের শেলি সিনেমা।
“হিন্দিতে রাজেশ খন্নার ‘আঁচল’ ছবিটিতেও তাঁরা পয়সা ঢেলেছিলেন। এ ছাড়া ধর্মেন্দ্রর ‘আতঙ্ক’ ছবিতেও ছিল তাঁদের লগ্নি। হিন্দি সিনেমা প্রযোজনার ক্ষেত্রে তাঁদের কোম্পানির নাম ছিল বেমিসাল ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড,” বলছিলেন সেই সময়ের এক প্রযোজক।
তাঁরা অনেকেই জানালেন, হিন্দি ছবির ডিস্ট্রিবিউশনের জগতে সঞ্চয়িতার এই লালি ফিল্মস প্রভূত ক্ষতি করেছে। “সেই সময়ে বেশি টাকায় ছবি কিনে তারা মার্কেটটা শেষ করে দিল। ঠিক যেমন আজকে টালিগঞ্জে করছে এই চিটফান্ড কোম্পানিগুলো,” বলছিলেন কৃষ্ণ দাগা।

“চারদিকে যা হয়েছে সেটা অপ্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা প্রফেশনাল। যারা টাকা নিয়ে আসছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা তো আমাদের কাজ না। হ্যাঁ, অ্যাক্টর-ডিরেক্টরদের একটা সতর্কতা কাজ করতে করতে এসেই যায়। তাঁরা প্রোডিউসরদের সঙ্গে মিটিং করলেই বুঝতে পারেন কোন প্রোডিউসর কতটা সিরিয়াস। তা ছাড়াও আমাদের দেখা উচিত আমরা প্রোডিউসরদের সঙ্গে কাজ করছি না ফাইনান্সারদের সঙ্গে? এই বিভেদটুকু করতে পারলে কোনও সমস্যা হবে না। বহু বছর ধরে বাংলা ছবিতে এ রকম ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে। মানিকদা, মৃণালদার মতো পরিচালকও তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁরা বহু হিন্দি ছবিও করেছেন। তাই আর্টিস্টদের দিকে আঙুল তুলে লাভ নেই। আর্টিস্টরা হল ডাক্তারদের মতো। ডাক্তার যখন অপারেশন করেন, তাঁরা কি রুগির ব্যাকগ্রাউন্ড দেখতে যান? আমরাও যখন ছবি করি তখন শুধু দেখি যে ছবি দর্শকদের ভাল লাগবে কি না।

তখন নাম ছিল সিলভার ভ্যালি কমিউনিকেশন
শ’য়ে শ’য়ে চিটফান্ড কোম্পানি টালিগঞ্জে ইনভেস্ট করলেও সব চেয়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট করেছে রোজ ভ্যালি ফিল্মস।
গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ হোক কী ‘শূন্য অঙ্ক’- বহু নামীদামি ছবির প্রযোজক তাঁরাই। এবং বাকি অনেকের মতো তাঁরা গত তিন-চার বছর ধরে ছবি করছেন এমন নয়। বহু দিন ধরেই সিনেমা প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত। তথ্য ঘেঁটে যা জানা গেল, ২০০১ সালে তারা পা রাখে টলিউডে। সেই সময় তাদের কোম্পানির নাম রোজ ভ্যালি ছিল না, ছিল সিলভার ভ্যালি কমিউনিকেশনস।
সেই ছবিতে ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও অর্পিতা পাল। বেশ কিছুদিন শ্যুটিংয়ের পরে কোনও একটা ঝামেলার কারণে যখন ছবির শ্যুটিং বন্ধ হয় তখন সিলভার
ভ্যালি কমিউনিকেশনস জয়েন্ট প্রোডাকশন শুরু করে সুরিন্দর ফিল্মসের সঙ্গে। সুরিন্দর ফিল্মসের কর্ণধার সুরিন্দর সিংহের ছেলে আজকের টালিগঞ্জের প্রযোজক নিসপাল সিংহ রানে।
সেই ‘দেবা’ থেকে শুরু করার পর ধীরে ধীরে ২০০৭ থেকে তাঁরা আবার টলিউডে পুরোদমে ফিরে আসেন। “আমরা গত বারো বছর ছবি করছি। এবং ভবিষ্যতেও করব। সবাইকে আশ্বস্ত করে বলছি, রোজ ভ্যালি ফিল্মস বন্ধ হবে না। আমরা আগেও ছবি করেছি। আজও করছি, কালকেও করব,” সাফ জানাচ্ছেন রোজ ভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডু।
সেই সংস্থার তিনটে ছবি তৈরিও রয়েছে। অনীক দত্তর ‘আশ্চর্য প্রদীপ’, রাজা সেনের ‘কর্নেল’, আর সুদেষ্ণা রায় অভিজিৎ গুহ পরিচালিত ‘বিয়ে নট আউট’। “তিনটে ছবি রেডি। আমরা তিনটে ছবি যে ভাবে প্ল্যান করেছিলাম, সে ভাবেই করব। কোথাও কোনও অসুবিধে নেই,” রোজ ভ্যালির তরফ থেকে বললেন শ্যামল দত্ত।

চিট মানেই খারাপ নয়
কালকেও যদি গৌতম বাবুরা ছবি করেন, টালিগঞ্জের একটা অংশ মনে করছেন সেটা ইন্ডাস্ট্রির পক্ষেও ভাল।
এখানে বলিউড ও টলিউডের একটা বড় পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন অনেকেই। “মুম্বইতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের টাকায় শোনা যায় যে সব ছবি হয় সেগুলো বেশির ভাগই মেনস্ট্রিম। এখানে কিন্তু জিৎ কী দেবের সিনেমা চিটফান্ডগুলো করছে না। তারা বেশির ভাগ সময়ই এমন ছবি বানাচ্ছেন যাকে আমরা ‘নিউ এজ’ বাংলা সিনেমা বলি। তা হলে চিট ফান্ড কম্পানিগুলো মানেই খারাপ এ কথা বলব কেন! আর দেখুন, কার টাকা কোথা থেকে এসেছে সেটা দেখা তো অভিনেতার কাজ নয়। আর ‘মনের মানুষ’ আর ‘শব্দ’ও তো চিটফান্ডের বানানো ছবিই। সেই ছবি ভাল ব্যবসা করেছে আর ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে,” বলছেন রুদ্রনীল ঘোষ।
অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়, চিট ফান্ডের প্রযোজনায় অনেক ছবিতে কাজ করেছেন। সারদা কাণ্ড বাদ দিলে চিটফান্ড কোম্পানির লগ্নির ভাল দিক দেখতে পাচ্ছেন তিনিও। “আমরা যারা আর্টিস্ট, তাদের কাজ অনেক বেড়েছে। এত ছবি হচ্ছে বলে প্রচুর টেকনিশিয়ান কাজও পেয়েছে। কিন্তু যে হেতু এটা চিটফান্ড যেখানে পাবলিক মানি রয়েছে, সেটা নয়ছয় হওয়াটা সত্যিই দুঃখের। লোকে ভয়ও পেয়ে গিয়েছে এ বার,” বলছেন লকেট।

মা ভয় পেয়ে গিয়েছেন
মানুষ ভয় পেয়েছেন তো বটেই।
যেমন, গত মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ একটি ফোন আসে পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর কাছে। ফোন করছিলেন তাঁর মা, ষাট বছরের লীলা চক্রবর্তী। “মা আমাকে ফোন করে বলে, বাবার রিটায়ারমেন্টের টাকা পোস্ট অফিস থেকে তুলে তাঁরা একটি চিটফান্ড সংস্থাতে লাগিয়েছেন। এখন মা ভয় পেয়ে গিয়েছেন চারদিকের ঘটনা দেখে। বাবাও রোজ সেই কোম্পানির অফিসে ছুটছেন। চার দিকে একটা অসম্ভব আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে,” বলছিলেন রাজ।
রাজ কিন্তু একা নন। টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ানদের মধ্যে প্রায় আশি শতাংশ লগ্নি করেছেন এই কোম্পানিগুলোয়। “আমরা এঁদের ছবিতে কাজ করে দেখেছি এঁরা পেমেন্ট ভাল দেন। তার পর বড় বড় স্টারদের নিয়ে সিনেমা বানান। কাগজে ছবি দেখি তাঁদের পার্টির। সেই জন্যই আমরা সবাই ইনভেস্ট করেছি,” বলছেন এক মেক আপ আর্টিস্ট। একই অবস্থা টালিগঞ্জের আরও দুই নায়িকার। “আমার প্রায় লাখখানেক টাকা ইনভেস্ট করা আছে চিট ফান্ড এই কোম্পানিগুলোয়। কিছুই বুঝতে পারছি না, ভয় করছে খুব,” সে দিন শ্যুটিংয়ের ফাঁকে বলছিলেন তাঁদের এক জন।
এ রকম একটা অবিশ্বাসের পরিবেশ দেখে একটু হলেও নড়েচড়ে বসেছেন টলিউডের অনেকে। ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্কারস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া-এর সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে তাই বোঝা গেল। “দেখুন আমরা আনঅফিশিয়ালি ইমপা-র কাছে সিনেমায় যে সব চিটফান্ড কোম্পানি লগ্নি করেছেন তার লিস্ট চেয়ে পাঠিয়েছি। আমরা অনুরোধ করেছি তাদের, কারণ টেকনিশিয়ানরা অনেকেই ভীষণ ভয় পেয়ে
গিয়েছেন। তারা ডেইলি ওয়েজের ভিত্তিতেই কাজ করে। তাদের টাকা যাতে তাদের কাছে পৌঁছায় সেটা দেখা আমাদের কর্তব্য। আমরা তো ইন্ডিভিজুয়ালি প্রডিউসারদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে পারি না। সেটা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। আমরা তাই ইমপা-র দ্বারস্থ হয়েছি এবং আশা করছি ইমপা আমাদের সাহায্য করবে,” বলছিলেন স্বরূপ বিশ্বাস।
ভয়, কাঁচা টাকা, সোনার চেন, বড় গাড়ি, কথায় কথায় অ্যাডভান্স এ রকম বহুজাতীয় ককটেলের সন্মুখীন অনেকদিন হয়নি টলিগঞ্জ।
কিন্তু তার সঙ্গে উঠে আসছে অনেক প্রশ্ন।
যা পরিস্থিতি, কোনও প্রোডিউসার যদি ছবি শুরু করেন চিট ফান্ডের ভিতরকার কাহিনি নিয়ে, ছবি যে সুপার হিট হবে তা বলা বাহুল্য।
ছবির নাম হতেই পারে, টলিউডের ‘চিট্ট’ যেথা ভয়পূর্ণ!

এই সব কোম্পানির বিশেষত্ব
টাকা পয়সার পেমেন্টের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই কোনও সমস্যা হয় না
ছবি চলুক বা না চলুক একসঙ্গে সিনেমা হলের চার সপ্তাহের ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ছবি নামানো না যায়
যে নায়ক বাকি প্রযোজকদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক পান ৩ লাখ, তাঁকে কয়েক ক্ষেত্রে ছ’গুণ বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়
কখনও রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে ফোন করিয়ে অনিচ্ছুক তারকাদের রাজি করানো হয়
নিজেদের ছবির গানের সিডির বিরাট অর্ডার দেওয়া হয়। কয়েক সময় সেই সংখ্যা ২ লাখও ছাড়িয়ে যায়। “আমরা আমাদের ইনভেস্টরদের দেব, তাই এত অর্ডার করছি,” এটাই মুখে মুখে ফেরা ডায়লগ তাঁদের
সিনেমা হিট হল না ফ্লপ, তা নিয়ে মাথা ঘামান না
বাজেট দেড় কোটি টাকা হলেও ৫০ হাজার টাকা দিয়ে পাঁচতারা হোটেলে মিটিং হয়
জেলার সিনেমা হলে ছবি চালাতেই হবে বলে এক্সিবিটরকে বেশি টাকা দেওয়া হয়
আর্স্টিস্টদের তাদের নানা এজেন্ট মিটে নিয়ে যাওয়া হয়। কখনও বাঁকুড়া, কখনও মালদা প্রযোজকদের ধরনধারণ
বেশির ভাগ সময় সাদা সাফারি, চকচকে জুতো
ভীষণ দামি গাড়ি
চোখে নানা রঙের কনট্যাক্ট লেন্স
সঙ্গে টাই-কোট পরা, ইংরেজি জানা অ্যাসিস্ট্যান্ট, যার হাতে ল্যাপটপ বা দামি ট্যাবলেট
এক সঙ্গে পাঁচ থেকে ছ’টা ছবিতে লগ্নি করার আশ্বাস



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.