একশো দিনের প্রকল্পে রেকর্ড খরচ, গরিবের লাভ কতটা?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি বলেছেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্পে এ রাজ্য টাকা খরচ করেছে সব চাইতে বেশি। সেই কথা বলছে কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যও। ২০১২-১৩ সালের জন্য রাজ্য খরচ করেছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, যা ভারতে সর্বাধিক।
কিন্তু শ্রমদিবস তৈরিতে যখন অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থান কিংবা তামিলনাড়ু অনেক এগিয়ে, তখন সর্বাধিক খরচ কী করে করল পশ্চিমবঙ্গে? রাজ্যের এনআরইজিএস কমিশনার দিব্যেন্দু সরকার জানালেন, এর কারণ পশ্চিমবঙ্গে ‘নির্মাণদ্রব্য’ (মেটিরিয়ালস) খাতে খরচ করছে অনেক বেশি। গত বছরের হিসেব দেখাচ্ছে, হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে নির্মাণে। সেখানে অন্ধ্র খরচ করেছে ৮১৯ কোটি টাকা। তামিলনাড়ু খরচ করেছে এক কোটিরও কম। দুটি রাজ্যই পশ্চিমবঙ্গের চাইতে বেশি টাকা দিয়েছে মজুরিতে -- পশ্চিমবঙ্গ যেখানে আড়াই হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, সেখানে অন্ধ্র প্রদেশ তিন হাজার কোটি, তামিল নাড়ু প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
কেন এ রাজ্য দ্রব্যে বাড়তি খরচ করছে? দিব্যেন্দুবাবুর দাবি, গ্রামে আর কেউ মোরাম রাস্তা চায় না। পাকা রাস্তা, পুকুর পাড় বাঁধানো, নদীবাঁধ, বনসৃজন, এগুলি একশো দিনের প্রকল্পে হচ্ছে। স্থায়ী সম্পদ তৈরি হচ্ছে। তাই ‘দ্রব্য’ খাতে খরচও হচ্ছে। আইনেও বলা রয়েছে, ৪০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করা যায় এই খাতে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, গরিবের রোজগার বাড়ানোর জন্যই এই প্রকল্প। স্থায়ী সম্পদ অন্য প্রকল্পেও তৈরি করা যেতে পারে। মজুরি খাতে খরচ বাড়ানোর সুযোগ নেওয়া হচ্ছে না কেন?
রাজনীতির দৃষ্টিতে, শ্রমদিবস তৈরির প্রতিযোগিতায় বামফ্রন্টের চাইতে এগিয়ে তৃণমূল। গত আর্থিক বছরে তৈরি হয়েছে ১৮ কোটিরও বেশি কর্মদিবস, যা আগের বছরগুলির চাইতে অন্তত এক কোটি বেশি, ভারতে স্থান চতুর্থ। এ বছর প্রায় ৯০ হাজার পরিবার ১০০ দিন কাজ পেয়েছে। এও রেকর্ড।
কিন্তু এই প্রকল্পে গরিবের সুবিধে কতটুকু হচ্ছে, সে প্রশ্ন করলে কতগুলো খটকা লাগে।
এক, বছরের যে সময়গুলিতে কাজ থাকে না, সেই মাসগুলিতে দু’মুঠো খাবারের অভাব যাতে না হয়, যেন মহাজনের সুদের জালে জড়াতে না হয় পরিবারকে, তা নিশ্চিত করাই উদ্দেশ্য এই প্রকল্পের। তা করতে হলে তার হাতে সামান্য দু’টি টাকা গুঁজে দিলে হবে না। কিন্তু এ রাজ্যে ১২ লক্ষেরও বেশি (২২ শতাংশ) পরিবারই কাজ পেয়েছে বছরে ১০ দিন, বা তারও কম। এদের কাছে ওই প্রকল্পে কাজ পাওয়া আর না-পাওয়ায় তফাত খুব কিছু নেই। পঞ্চায়েত সচিব সৌরভ দাস তাঁর দফতরের পত্রিকা ‘পঞ্চায়েতী রাজ’-এ লিখছেন, বছরে ১৩৬০ টাকা রোজগার করে একটা পরিবারের দারিদ্রে খুব কিছু তফাত হবে না।
দুই, কাজের চাহিদা বেশি হওয়ার কথা গরিব জেলাতেই। কাজের বেলা কিন্তু দেখা যাচ্ছে, উত্তর ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলির মতো সমৃদ্ধ জেলায় কাজ হচ্ছে বেশি দিন। গরিব জেলা কাজ পাচ্ছে কম। উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার, মুর্শিদাবাদে কাজ হয়েছে রাজ্যের গড়ের (৩৩ দিন) অনেক কম।
তিন, গরিব জেলায় কাজও পাচ্ছে কম পরিবার। বর্ধমানে যত পরিবারের জব কার্ড রয়েছে তাদের ৭৩ শতাংশই কাজ পেয়েছে। উত্তর দিনাজপুরে সেখানে কাজ পেয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ।
প্রশাসনের কর্তারা একান্তে স্বীকার করছেন, পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে প্রশাসনও দুর্বল, সেখানে কাজ তৈরি করা কঠিন। তবে তাঁদের দাবি, পঞ্চায়েত দফতরের তৎপরতায় এখন দুর্বল জেলাগুলোও আগের চাইতে বেশি টাকা খরচ করছে। তা হয়ত হচ্ছে, কিন্তু রাজ্যে দারিদ্রের মানচিত্র বদলাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, একশো দিনের কাজ যা পেরেছে, তা হলে শ্রমের বাজার তৈরি করতে, যেখানে শ্রমিক তাঁর খুশিমতো শ্রম বিক্রি করতে পারেন। তাই ন্যূনতম মজুরিও বেড়েছে। সেই দৃষ্টিতে রাজ্যে কর্মদিবস সর্বত্র সমান বেড়ে না থাকলেও, সব জেলাতেই গরিবদের কিছু উপকার হয়েছে।
সেই দৃষ্টিতে দেখলে মোট খরচ বাড়ানোর চাইতে কর্মদিবস বাড়ানো বেশি জরুরি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কৃষিমজুরি সংক্রান্ত একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যে রাজ্যে একশো দিনের প্রকল্পে গড় কর্মদিবস বেশি, সেখানে মজুরির হারও বেড়েছে। যেমন, ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে ধান-কাটার মজুরি (৬১ টাকা) ছিল অন্ধ্র প্রদেশের চাইতে তিন টাকা বেশি। ২০১২ সালে দেখা যাচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশে মজুরি (১৭১ টাকা) পশ্চিমবঙ্গের চাইতে ১৬ টাকা বেশি।
এর অন্তত একটা কারণ এই যে, পশ্চিমবঙ্গ যেখানে বছরে ১৮ কোটি কর্মদিবস তৈরি করছে, অন্ধ্র প্রদেশ সেখানে ২৭ কোটি কর্মদিবস তৈরি করছে, বলেন অচিনবাবু। তাই রাজ্য সরকার বেশি কাজের দিন তৈরি করতে পারছে, খেতমজুরের শ্রমের দাম তত বাড়বে। একশো দিনের কাজ যারা পাননি, তাঁরাও লাভবান হবেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.