অটোরিকশা আইনসিদ্ধ করতে তাতে মিটার বসানোর নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু তা মানতে নারাজ শহরের ট্যাক্সি ও অটো ইউনিয়নগুলি। এমনকী, খোদ পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও শনিবার মহাকরণে মন্তব্য করেন, এত অটোয় একবারে মিটার বসানো কঠিন। বিভিন্ন স্তরে আলোচনা করে তবেই এই কাজের দিকে এগোবে সরকার। তিনি বলেন, “আমরা হাইকোর্টের নির্দেশ মতো কাজ করছি। কিন্তু ৭০-৮০ হাজার অটো এখানে। মিটার বসানো খুবই কঠিন। আমরা রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলের কাছে মতামত চেয়েছি। তিনি কী পরামর্শ দেন, তা দেখে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” অথচ, শুরু থেকে মিটারেই চালাচল করার কথা এই যানের। তেমন নিয়ম রয়ে গিয়েছে শুধু খাতায়-কলমে।
প্রথম প্রথম ট্যাক্সির মতোই মিটার দেখে অটোর যাত্রীরা ভাড়া মেটাতেন। সেই আমলে কয়েক বছর এ শহরে অটো চালিয়েছেন অভিজিত্ দাস। তাঁর মতে, “সিপিএমের রাজনীতির হিসেবই সব কিছু ওলটপালট করে দিল।” মিটার ছাড়া চালানোই শুধু নয়, প্রায় জন্মলগ্ন থেকে চলে আসছে অটোয় হরেক রকম অনিয়ম। আইন না মানাই অটোর ভবিতব্য কলকাতায়।
৩০ বছর আগে এ শহরে প্রথম পর্যায়ে ৭০০ অটোর লাইসেন্স দেওয়া হয়। প্রতিটিতেই মিটার ছিল। আটের দশকের শেষের দিকে চালকেরা মিটারের বদলে রুটের যাত্রী নিতে শুরু করেন। অভিজিত্বাবু অটো চালাতে শুরু করেন ১৯৮৬ থেকে। তাঁর কথায়, “হঠাত্ই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ইচ্ছেমতো রুট তৈরি শুরু হল। শুরু হল মর্জিমাফিক ভাড়া নেওয়া।” কেন? প্রবীণ চালকদের একাংশের মতে, এতে চালকেরা আর্থিক ভাবে উপকৃত হতে শুরু করলেন। তাঁদের একটি বড় অংশ লাল ঝান্ডার নীচে সঙ্ঘবদ্ধ হলেন। পরিবহণের এই ক্ষেত্রটির উপরে মৌরসিপাট্টা জারি হল ওঁদের। |
অভিযোগটি পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেননি সিটু নেতা রাহুল সান্যাল। ২৫ বছর ধরে অটো চালাচ্ছেন এ শহরে। তাঁর বক্তব্য, “মিটার তুলে দেওয়ায় চালকদের আয় কিছুটা বাড়লেও মূলত উপকৃত হয়েছিলেন যাত্রীরাই।” তাঁর যুক্তি, গোড়ায় প্রচলিত ‘কলকাতা পারমিট’ থাকা অটো বেশ কিছু জায়গায় যেতে পারত না। ধীরে ধীরে চাহিদার জন্য এ সব বিধি-নিষেধ শিথিল হয়ে যায়।
কিন্তু দেশের অন্যান্য শহরে যদি মিটারে অটো চলতে পারে, তবে কেন এ রাজ্যে পারবে না? প্রশ্নটি তুলেছেন তৃণমূল কংগ্রেস-নিয়ন্ত্রিত অটোচালক ইউনিয়নের সভাপতি তথা বিধানসভায় শাসক দলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আসলে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে।” অন্য দিকে সিটু-নিয়ন্ত্রিত অটোচালক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বাবুন ঘোষ বলেন, “মিটারে অটো চালানো সম্ভব নয়।” কেন? তাঁর যুক্তি, “বাস্তব পরিস্থিতি সে রকম নয়।”
কেবল মিটারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোই নয়, পথ-আইন মানার বালাইও নেই এ শহরের অটোর। এই নৈরাজ্যের মাসুল গুনতে হচ্ছে শহরবাসীকে। দুর্ঘটনার আশঙ্কার পাশাপাশি বাড়ছে যানজট। যাত্রী-নিরাপত্তার স্বার্থে ১৯৯৬ সালে রাজ্য সরকার অটোয় চার জনের বেশি যাত্রী নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সঙ্গে বলা হয়, মাঝরাস্তায় যাত্রী নিতে বা নামাতে যত্রতত্র অটো দাঁড় করানো যাবে না। হঠাত্ করে ‘ইউ টার্ন’-ও নেওয়া যাবে না। তত্কালীন পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী অটো-সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মহাকরণে বৈঠক করে জানান, আইন ভাঙলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু হুমকিই সার। এর পরেও নানা সময়ে পথ-আইন মানতে অটোচালকদের মহাকরণ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। লাভ হয়নি সে সবেও। ২০১১-এ পালাবদলের আগে পর্যন্ত অটো-ইউনিয়ন ছিল পুরো সিটু-নিয়ন্ত্রিত।
চালকেরা কেন মানেননি আইন? সিটু-নিয়ন্ত্রিত ‘কলকাতা অটো অপারেটর্স ইউনিয়ন’-এর সাধারণ সম্পাদক বাবুন ঘোষ বলেন, “সব দোষ অটোচালকের উপরে চাপালে চলবে না। এমন নয়, যাত্রীদের আপত্তি উপেক্ষা করে চালকই শুধু পাঁচ জনকে তুলছেন। প্রয়োজনের স্বার্থে যাত্রীরাও অটোতে পাঁচ জন করে ওঠেন।” ট্রাফিক আইন ভাঙার দায়ে প্রচুর চালকের কাছ থেকে পুলিশ জরিমানা নেয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে গত বছর ৮ এপ্রিল মদন মিত্র অটোচালকদের সভা ডাকেন। ইতিমধ্যে গজিয়ে উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেস-সমর্থিত অটোচালকদের একাধিক সংগঠন। এ শহরে ‘অটো-নৈরাজ্য’ চলছে এই মন্তব্য করে মদনবাবু বলেন, “এর জন্য সিপিএমের ৩৪ বছরের সরকার দায়ী।” চার জনের বেশি যাত্রী অটোয় না নিতে তিনি হুঁশিয়ারি দেন। ‘অটো-নৈরাজ্যের’ অবসানের জন্য সরকারি কমিটি তৈরি করেন তিনি।
এই কমিটিও অটোয় চার জনের বেশি যাত্রী না তোলার সুপারিশ করে। মন্ত্রী পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে সে কথা জানিয়েওছিলেন। কিন্তু এ বারেও নির্দেশ আটকে থাকে সেই মহাকরণের ঘেরাটোপেই।
কেন এই হাল? শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নিরাপত্তা আইনের স্বার্থে আমিও বলব, অটোয় বাড়তি যাত্রী না নিতে। কিন্তু তেলের দাম যে ভাবে বেড়েছে, তাতে বাধ্য হয়ে চালকেরা বাড়তি যাত্রী নেন। এতে যাত্রীদেরও সুবিধা হয়। অন্যথায় গন্তব্যে যেতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তাঁদেরও।” |